করোনা অতিমারির কারণে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ কার্যত নিষিদ্ধ। সেই সুযোগে চলছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের তরফে একের পর এক শিক্ষা ধ্বংসকারী পদক্ষেপ। দেড় বছর ধরে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনাও বন্ধ। তাই ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক সকলেরই দাবি, অবিলম্বে এগুলি খুলে দাও। ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল, ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠন, অভিভাবক ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার রোডম্যাপ তৈরি করা হোক। কিন্তু সরকার মূক ও বধিরের ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছে। বাধ্য হয়ে ২৬ জুলাই এআইডিএসও-র নেতৃত্বে রাজ্যের ছাত্রসমাজ গোটা রাজ্যে প্রতীকী অবরোধের ডাক দেয়। শতাধিক জায়গায় ছাত্রছাত্রীরা অবরোধ করে। কিন্তু দাবিগুলি মেনে নেওয়ার পরিবর্তে আন্দোলনে তৃণমূল সরকারের পুলিশ অত্যাচার নামিয়ে আনল। বাঁকুড়ায় ১১ জন ছাত্রছাত্রীকে ব্যাপক মারধর করে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার করে জেলে ভরা হল। কলকাতায় ২৮ জন ছাত্রছাত্রীকে গ্রেপ্তার করা হল। এস ইউ সি আই (সি)-র রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য ওই দিন এক বিবৃতিতে এর তীব্র নিন্দা করেন।
ছ’দিন জেলে কাটানোর পর ৩১ জুলাই ১১ জন ছাত্রছাত্রী জামিনে মুক্ত হলেন। রাজ্য জুড়ে ছাত্র শিক্ষক অভিভাবকরা প্রশ্ন তুলেছেন, জামিন অযোগ্য ধারা কীসের ভিত্তিতে? এরা কি ক্রিমিনাল? আসলে এই মিথ্যা মামলার উদ্দেশ্য আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়া। সোসাল মিডিয়া থেকে রাজপথ সর্বত্র এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ১১ জন বন্দি দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন সংশোধনাগারের দিকে– সোসাল মিডিয়া জুড়ে ঘুরতে থাকা এ ছবি নতুন করে বাংলার বামপন্থী আন্দোলনের সংগ্রামী স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিয়েছে।
এআইডিএসও-র বক্তব্য, পাঞ্জাব, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, বিহার সহ বেশ কিছু রাজ্য স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ খুলবে না কেন? ছাত্রছাত্রীদের দ্রুত টিকা দিয়ে কোভিড বিধি মেনে স্কুল খুলতে হবে। যখন জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক, দোকান-বাজার-অফিস যানবাহন খুলে দেওয়া হয়েছে, খুলে দেওয়া হয়েছে শপিংমল-সিনেমা হল-মদের দোকানও তখন শিক্ষার মতো অপরিহার্য বিষয় বাদ কেন, কেন ক্লাসরুম ভিত্তিক পঠনপাঠন চালু করা হচ্ছে না?
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ ঘোষণা করেছে ভারতবর্ষে অফলাইন পঠন-পাঠন শুরু করা যায়। অভিভাবকরাও চাইছেন তাদের সন্তানেরা যেন ক্লাসরুম শিক্ষার সুযোগ পায়। তখন সরকারের কেন এই অনীহা? বাস্তবে এর পিছনে রয়েছে শাসক শ্রেণির এক গভীর চক্রান্ত, যা তারা অতিমারির সুযোগে দেশজুড়ে জারি করার চেষ্টা করছে। তাদের উদ্দেশ্য শিক্ষাকে অনলাইন নির্ভর করে দেওয়া। এতে অনলাইনের কারবারিরা ফুলে-ফেঁপে উঠছে। গুরুত্ব হারাচ্ছে ক্লাসরুম নির্ভর শিক্ষা। ছাত্র-শিক্ষকের আদানপ্রদানের মাধ্যমে ছাত্রের যে নৈতিক মান গড়ে ওঠে তাও হচ্ছে না। আগামী দিনে শিক্ষক নিয়োগও মারাত্মক ভাবে কমে যাবে। অন্যদিকে গরিব-নিম্নবিত্ত ছাত্রদের কাছ থেকেও শিক্ষার সুযোগ কেড়ে নেওয়া সহজ হবে।
প্রতিবাদে রাস্তায় নামে এআইডিএসও। দাবি জানায়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে সকল ছাত্রছাত্রীর উচ্চশিক্ষায় ভর্তি সুনিশ্চিত করতে হবে। ছাত্রদের জন্য পরিবহণে এক-তৃতীয়াংশ ভাড়া নিতে হবে। ২ জুলাই বিধানসভা গেটের বাইরে তারা বিক্ষোভ দেখায়। তখন তৃণমূল সরকারের পুলিশ ব্যাপক মারধর করে, ছাত্র কর্মীদের গ্রেফতার করে। শিক্ষাজীবনকে অবরুদ্ধ করার প্রতিবাদে ২৬ জুলাই গোটা রাজ্যে প্রতীকী অবরোধের ডাক দেওয়া হয়। এতেও নির্মম হামলা চালিয়ে শতাধিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হল। সংগঠনের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক-সভাপতি সহ ১১ জন কর্মীকে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার করা হল। এর মধ্যে চারজন ছাত্রীকর্মী, দু’জন পরীক্ষার্থী। জেলের ভিতরে অসুস্থ হয়ে পড়লেও মেলেনি ওষুধ কিংবা প্রয়োজনীয় পোশাক। এই অমানবিক আচরণ রাজ্যবাসীকে অত্যন্ত আহত করেছে। শাসকের দমন-নীতির বিরুদ্ধে ও বন্দি ছাত্রদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ৩১ জুলাই রাস্তায় নামে এ আই ডি এস ও, এ আই ডি ওয়াই ও, এ আই এম এস এস। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট, হাজরা এবং প্রতিটি জেলায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। কলেজ স্ট্রিটে কর্মীদের উপর পুলিশ অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নৃশংস লাঠিচার্জ করে, মহিলা কর্মীদের চুলের মুঠি ধরে মারে, অশালীন আচরণ করে এবং ৩৮ জনকে গ্রেফতার করে।
ক’দিন পরেই স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ উদযাপিত হবে। ভারত বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ বলে কত ভাষণের ফুলকি উড়বে। আর এ দিকে রাজপথে ঝরবে ছাত্র-যুব-শ্রমিক-কৃষকের রক্ত। এই হল স্বাধীনতার প্রকৃত রূপ! দেশের মানুষ দেখছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করার জন্য জেএনইউ, জামিয়া সহ সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের জামিন অযোগ্য ধারায় কেস দিয়ে জেলে পুরছে। গুজরাট-মধ্যপ্রদেশ-কর্ণাটক-ত্রিপুরাতে বিজেপি সরকার এআইডিএসও-র নেতৃত্বে আন্দোলনকে দমন করছে, এ রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারও ঠিক একই রাস্তা নিয়েছে। কার্যত এই সরকারও বিজেপি সরকারের সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ চালু করার পক্ষে, মুখে তারা যাই বলুক। তবে আশার বিষয় হল সারা রাজ্যব্যাপী শিক্ষাবিদ অভিভাবক এবং নানা স্তরের মানুষের এই আন্দোলনের প্রতি ব্যাপক সহমর্মিতা। বাঁকুড়া জেলায় আইনজীবীদের স্বতঃস্ফূর্ত সওয়ালে অবশেষে ১১ জন সংগঠককে জামিন দিতে বাধ্য হয় রাজ্য প্রশাসন। আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ পৌঁছে গেছে রাজ্যের প্রান্তে প্রত্যন্তে। আন্দোলনের প্রতি গভীর আবেগ ব্যক্ত করেছেন বহু সাধারণ মানুষ। এক পুলিশ কর্মচারী বলেছেন, ‘উর্দি পরে প্রশাসনের আদেশ পালনে বাধ্য হলেও, আমিও এক ছাত্রের বাবা। আমি জানি আমার সন্তানের ভাল হবে এ আন্দোলন জয়যুক্ত হলে। তোমরা লড়াই চালিয়ে যাও, তোমাদের জয় নিশ্চিত।’ শত শত মানুষের আকাঙ্খাকে বুকে নিয়ে এআইডিএসও শপথ গ্রহণ করেছে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। শিক্ষার ওপর নেমে আসা আক্রমণ সহ যে কোনও অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে বারবার আন্দোলনে মুখরিত হবে তারা।