গত ২১ সেপ্টেম্বর দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর পৌরোহিত্যে খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতির উপর সেন্ট্রাল অ্যাডভাইসরি বোর্ড অফ এডুকেশনের (ক্যাব) সভায় উপস্থিত বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিরা কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির তীব্র বিরোধিতা করেন৷
শিক্ষানীতিতে ‘রাষ্ট্রীয় শিক্ষা আয়োগ’ (আরএসএ) বা ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ নামে একটি নয়া সংস্থা গড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়৷ এই নতুন সংস্থার উপর বিদ্যালয় শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা তথা সমগ্র শিক্ষার ভার অর্পিত হবে৷ ‘আরএসএ’–র চেয়ারপার্সন হবেন প্রধানমন্ত্রী নিজে, ভাইস চেয়ারপার্সন হবেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী৷ অর্থাৎ দেশের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাটি নিয়ন্ত্রণ করবেন প্রধানমন্ত্রী নিজে৷ প্রধানমন্ত্রীকে শীর্ষে রেখে আরএসএ গঠনের বিরুদ্ধে যে সব রাজ্য থেকে নানা ভাষায় তীব্র বিরোধিতা হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হল গুজরাট, দিল্লি, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, মিজোরাম ইত্যাদি৷ মোদীর রাজ্য গুজরাটের শিক্ষামন্ত্রী মনুভা চুদসামার বিরোধিতার সুরটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ৷ তিনি বলেছেন, ‘‘এটা এক ধরনের সমান্তরাল প্রশাসনের ইঙ্গিত৷ ইতিমধ্যেই নানা কর্তৃপক্ষ রয়েছে৷ নতুন করে আরও একটি কর্তৃপক্ষ বা আয়োগের প্রয়োজন নেই’’ (এই সময়, ১০/১০/১৯)৷ অন্য রাজ্যের প্রতিনিধি ও শিক্ষামন্ত্রীরা তাঁকে সমর্থন করেছেন৷
যে ইউজিসিকে অবলুপ্ত বা পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র মোদি সরকার গত পাঁচ বছর ধরে করে আসছে এবং যা করতে পারলে আরএসএ–র চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে বলে সরকার ভাবছে সে সম্পর্কেও গুজরাট মন্ত্রীর বক্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ৷ তিনি বলেছেন, ‘ইউজিসি এতদিন ধরে খুব ভাল কাজ করেছে৷ যা পরীক্ষিত এবং সফল, তেমন সংস্থা তুলে না দিয়ে তার শক্তিবৃদ্ধিই শ্রেয়’ (ঐ)৷ ইউজিসি সম্পর্কে এই বক্তব্য কেন্দ্রীয় সরকারের মতের ঠিক বিপরীত৷ উল্লেখ করা যেতে পারে, স্বাধীনতার পরে একটি স্বশাসিত সংস্থা হিসাবে ইউজিসি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল দেশ জুড়ে উচ্চশিক্ষার মানের সমতা প্রদান ও তার জন্য অর্থ মঞ্জুর করার উদ্দেশ্যে৷ যতদিন গেছে ইউজিসি–র স্বশাসনের প্রতি কোনও মর্যাদা না দিয়ে কংগ্রেস, বিজেপি যে যখন ক্ষমতায় এসেছে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে তার অপব্যবহার করেছে৷ গত পাঁচ বছরের বিজেপির শাসন কালে এই অপব্যবহার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল৷ আরএসএস ও সংঘ পরিবারের তথাকথিত হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেণ্ডাকে বারবার ইউজিসি–র নির্দেশিকার মাধ্যমে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা কার্যকরী করতে চেয়েছে৷ আবার অনিয়মের অভিযোগ তুলে পূর্ববর্তী বিজেপি সরকার ইউজিসিকে তুলে দিয়ে হায়ার এডুকেশন কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া নামে নতুন এক কমিশন তৈরি করার জন্য উঠে পড়ে লাগে৷ প্রস্তাবিত ঐ কমিশনে স্বশাসনের বিন্দুমাত্র সুযোগ তারা রাখেনি৷
গুজরাটের শিক্ষামন্ত্রী কেবল কেন্দ্রীয় স্তরে প্রস্তাবিত আরএসএ–র বিরোধিতা করেননি৷ রাজ্যস্তরে ‘এসএসআরএ’ নামে একটি সংস্থা গঠনের যে প্রস্তাব খসড়া নীতিতে দেওয়া হয়েছে তারও বিরোধিতা করেছেন৷ এই ‘এসএসআরএ’ হল আরএসএ–র রাজ্য প্রতিরূপ বা কাউন্টারপার্ট, যার মাথায় বসানোর কথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে৷ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার উপর ছড়ি ঘোরাবেন দিল্লিতে বসে, রাজ্যে রাজ্যে তা করবেন মুখ্যমন্ত্রীরা– এটাই হল খসড়া নীতির পরিকল্পনা৷
দিল্লি রাজ্য সরকার আরএসএ–র বিরোধিতার সাথে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে বলেছে, ‘সরকার পোষিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ যতটা আছে, শিক্ষার জন্য অর্থানুকূল্য ঠিক ততটাই কম’৷ দিল্লি রাজ্যের প্রতিনিধি শিক্ষার উপর এত সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমানোর দাবি করেছেন৷ কেরালার শিক্ষামন্ত্রী আরএসএ গঠনের প্রস্তাবকে শিক্ষায় চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণের ঝোক হিসাবে বর্ণনা করে তার বিরোধিতা করেছেন৷ মধ্যপ্রদেশও শিক্ষার এই কেন্দ্রীকরণের ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করে বলেছে, ‘এর ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজ্যের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ হবে’৷ মিজোরামের মতো রাজ্যও আরএসএ–র বিরোধিতা করেছে৷ ঐ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘আরএসএ গঠন করতে গেলে ভারতীয় সংবিধান মেনে তা করতে হবে’৷ বস্তুত, সংবিধান যেখানে শিক্ষাকে যৌথ তালিকাভুক্ত করেছে সেখানে গোটা শিক্ষাকে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে আনা আসলে সংবিধান অমান্য করার সমতুল্য৷ উপস্থিত প্রায় সব রাজ্য জিডিপি–র ৬ শতাংশ হারে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের জন্য দাবি করেছে৷ অন্ধ্রপ্রদেশ, দিল্লি, পাঞ্জাব, রাজস্থান, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা প্রভৃতি রাজ্য সরকার এই দাবির পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছে৷ দিল্লি আরও এক ধাপ এগিয়ে এই বরাদ্দ সুনিশ্চিত করার জন্য আইন করার দাবি করেছে৷ রাজস্থান সরকারের মন্ত্রী বলেছেন, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির কেন্দ্র ও রাজ্যের আর্থিক বরাদ্দের অনুপাত ৯০,১০ থেকে কমে ৬০,৪০–এ নেমে এসেছে এবং তিনি আর্থিক অনুদান বৃদ্ধির দাবি করেছেন৷
খসড়া শিক্ষানীতিতে গালভরা নানা প্রস্তাবের স্রোত বয়ে গেলেও তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথা থেকে আসবে তার কোনও সুপারিশ নেই৷ খসড়া প্রস্তুতকারকরা সে ব্যাপারে বাস্তবে নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করেছেন৷ অথচ বহুদিন ধরে শিক্ষাবিদদের দাবি, বাজেটের ১০ শতাংশ বা মোট উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে হবে৷ প্রতি বছর বাজেট আসে, আর শিক্ষার জন্য ব্যয় বরাদ্দ ক্রমাগত হ্রাস পেতে পেতে ১–২ শতাংশে নেমে আসে৷ অথচ সরকার পোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক বরাদ্দ কমিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে কোটি কোটি টাকা অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা করছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার৷ মোদীজির শিক্ষামন্ত্রীর প্রাণ বেশি কাঁদে আম্বানিদের জিও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যা এখনও প্রতিষ্ঠাই হয়নি এবং তা সত্ত্বেও তাকে দেশের একটি উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা করে সরকারের হাজার কোটি টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ হয়ত এই সব কথা মনে রেখেই বিহার সরকার ওই সভায় দাবি করেছে ‘কোনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি অনুদান দেওয়া চলবে না’৷ এসব কারণেই হয়ত দিল্লি রাজ্য সরকার মন্তব্য করেছে, ‘এই খসড়া নীতি শিক্ষাকে বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের দিকে নিয়ে যাবে’৷