পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী সোস্যাল মিডিয়া মারফত জনসাধারণের কাছে শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনের জন্য পরামর্শ চেয়েছেন৷ এর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় মানুষের অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ কারণ বাস্তব জীবনে এমন অভিজ্ঞতা তাদের কখনও হয়েছে বলে তারা সম্ভবত মনে করতে পারেন না৷ নিন্দুকেরা বলছে, লোকসভা নির্বাচনে জোর ধাক্কা খেয়ে হঠাৎ সম্বিত ফিরেছে৷ ভোটের ধাক্কা না স্বাভাবিক বোধোদয়– এসব তর্ক সরিয়ে রেখে কয়েকটি কথা ভেবে দেখার জন্য বলা যায়৷
একজন সাধারণ পিতা–মাতা কী চান? তার সন্তান শিক্ষা পাক৷ অথচ আজ শিক্ষালাভের প্রধান অন্তরায় বিপুল পরিমাণ ফি–এর বোঝা৷ স্কুলশিক্ষা থেকে শুরু করে উচ শিক্ষা পর্যন্ত টাকা না থাকলে শিক্ষা নেই৷ অধিকাংশ স্কুলেই সরকার নির্ধারিত ফি–এর থেকে অতিরিক্ত ফি নেওয়া হয়৷ সরকার চাইলে এটা আটকাতে পারে৷ অন্যদিকে, স্কুলের শিক্ষকরা বলছেন, স্কুল চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় খরচ সরকার দেয় না৷ পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, স্কুলের টাকায় আংশিক সময়ের শিক্ষক দিয়ে ক্লাস চালাতে হয়, এমনকী বিয়ে–শ্রাদ্ধ ইত্যাদির জন্য স্কুল ভাড়া দিয়েও টাকা জোগাড় করতে হয়৷ সরকার কি এসব জানে না? এ ভাবে কি সকলের শিক্ষা হয়? সকলে শিক্ষা পেতে পারে? তাই টাকার অভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী৷ স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি অন্যতম দাবি– শিক্ষা হবে অবৈতনিক৷ যেখানে ধনী–দরিদ্র, হিন্দু–মুসলিম কোনও ভাগ থাকবে না, বাস্তবে তা হলেই সকলের জন্য শিক্ষা সম্ভব৷
সরকারি স্কুলগুলোতে পরিকাঠামোর অভাবের কথা সকলেই জানেন৷ শিক্ষামন্ত্রী জানেন না, নিশ্চয়ই এমন নয়৷ কিন্তু পরামর্শ চাইলে, বলতেই হয় শিক্ষার পরিবেশ–পরিকাঠামো গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের৷ লাইব্রেরি–ল্যাবরেটরি অভাব নিয়ে ভগ্ণদশা বিদ্যালয়গুলিতে পাশ–ফেলও নেই৷ সিপিএম সরকার প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ও পাশ–ফেল তুলে দিয়ে শিক্ষার ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিল৷ তৃণমূল ক্ষমতায় এসে কেন্দ্রীয় আইনের দোহাই দিয়ে এ রাজ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দিয়েছে৷ সরকার পরামর্শ না চাইলেও, শিক্ষার স্বার্থে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ বারবার পাশ–ফেল চালুর দাবি জানিয়ে এসেছে৷ লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাক্ষর সহ দাবিপত্র দেওয়া হয়েছে, এমনকী গত ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই এস ইউ সি আই (সি) দলের আহ্বানে পাশ–ফেল চালুর দাবিতে জনসাধারণ ধর্মঘট করতে পর্যন্ত প্রস্তুত ছিল৷ সেদিন শিক্ষামন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পাশ–ফেল চালু হবে৷ অথচ আজও তা চালু হয়নি৷ এমনকী আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রীয় সরকার(লোকসভা, রাজ্যসভায় আইন সংশোধনে বাধ্য হয়ে) পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল চালুর ঘোষণা করেছে, সেটাও এ রাজ্যে এখনও চালু হয়নি৷
ফলে যে বাবা–মা চান তাঁদের সন্তান শিক্ষা পাক, তাঁরা কষ্টার্জিত আয়ের সিংহভাগ খরচ করে ছেলেমেয়েদের বেসরকারি স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন৷ সরকারি স্কুলে সুন্দর স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ থাকলে বেসরকারি স্কুলে সন্তানকে পাঠানোর প্রয়োজন হয় না৷ তাই সরকারি স্কুলে পাশ–ফেল চালু করা এবং উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা সরকারের প্রধানতম কাজ৷ একদিকে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার, অথচ হাজার হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীর পদ শূন্য৷ উপযুক্ত যোগ্যতামান নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে পা্যনেলভুক্ত হয়ে ঘরে বসে আছেন, চাকরি মেলেনি–এমন যুবক–যুবতীর সংখ্যা কম নয়৷ পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ– এই দুর্নীতি সিপিএম আমলের মতো সূক্ষ্ম আবরণের আড়ালে নেই, একেবারে খুল্লমখুল্লা, সকলেই জানেন৷ জমি বিক্রি করে, মায়ের গয়না বিক্রি করে, কত অসহায় বেকার ছেলেমেয়েরা টাকা দিয়েছে তৃণমূলের নেতাদের৷ শিক্ষক হওয়ার জন্য যাকে ঘুষ দিতে বাধ্য করা হয়, তার কাছে শিক্ষার উৎকর্ষের জন্য যথাযথ ভূমিকা প্রত্যাশা করা যায় কি? এ দুর্নীতি বন্ধ না করলে, শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে পরমার্শ চাওয়া শুধুই কথার কথা থেকে যাবে৷ একইরকম দুর্নীতি কলেজে ভর্তির সময়৷ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতারা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের থেকে টাকা তোলে– এ কী কারও বানানো কথা? সরকার জানে, শিক্ষা দপ্তর জানে৷ শুধু অনলাইন ভর্তির ফরমান দিলেই এ দুর্নীতি বন্ধ করা যায় না৷ দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন সদিচ্ছা, যারা দুর্নীতির সাথে যুক্ত তাদের শাস্তি দেওয়া৷ অথচ দুর্নীতিগ্রস্থ তোলাবাজদের আড়াল করার সরকারি চেষ্টাই আমরা দেখতে অভ্যস্ত৷ এর বদল অত্যন্ত প্রয়োজন৷
শিক্ষাক্ষেত্রে দলবাজি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছিল৷ অথচ সিপিএমের মতোই শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হচ্ছে৷ কলেজে ছাত্র কাউন্সিল চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচ প্রয়োজন নির্বাচিত ছাত্র ইউনিয়ন, যে ইউনিয়ন ছাত্রস্বার্থে কাজ করবে, অন্যায়–দুর্নীতি হলে প্রতিবাদ করবে৷ এমনকী স্কুল পরিচালক কমিটি, কলেজ পরিচালন কমিটিও গঠন করতে হবে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে৷ না হলে, পরিচালন সমিতিও সরকারি, ইউনিয়নও সরকারি– ফলে দুর্নীতিও সরকারি দুর্নীতিতে পরিণত হয়৷ শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে এ এক মস্ত বাধা৷ সরকারের সদিচ্ছা থাকলে একে অপসারণ করা যায়৷ যুগোপযোগী আধুনিক শিক্ষাপ্রণালী, সিলেবাস, পরীক্ষাপদ্ধতি– এসব তৈরি করার উপযুক্ত জ্ঞানসম্পন্ন বিদ্বজ্জনের কি আমাদের দেশে খুব অভাব? অথচ শিক্ষাসংক্রান্ত অধিকাংশ কমিটির মাথায় রাখা হয়, শিক্ষার সাথে সম্পর্কহীন দলীয় নেতামন্ত্রীকে৷ এতে কি শিক্ষার উৎকর্ষ বাড়ে? সরকার টাকা দেয়, তাই সরকারি মতকেই মানতে হবে, এহেন শিশুসুলভ আবদার শিক্ষার স্বার্থের পরিপন্থী৷ শিক্ষার জন্য টাকা দেওয়াটা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে৷ ফলে সরকার তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করলেই শিক্ষার উন্নতি হতে পারে, নচেত এত ‘ধর্মে’র কথা শুনিয়ে লাভ নেই৷
আমরা জানি, যথার্থ ধর্মী নিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক শিক্ষাই একজন শিশুকে যথার্থ যুক্তিভিত্তিক মননের অধিকারী করে তোলে৷ এর প্রয়োজন অতীতেও ছিল, আজ আরও বেশি প্রয়োজন৷ আর এস এস–বিজেপি সমাজ মননে যে বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে, তাকে প্রতিহত করতে হলে শুধু সংখ্যাধিক্যের জোরে আস্ফালন করে হবে না৷ শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে ধর্ম থেকে বিযুক্ত করতে হবে৷ সর্ব ধর্মকেই উৎসাহ দিয়ে এ জিনিস হয় না৷ একমাত্র যুক্তি–বিজ্ঞান দিয়ে সত্য বিচার করে যে মানুষ, তাকে কোনওভাবেই ধর্মের নামে উন্মাদ করে তোলা যায় না৷ আর এমন মানুষ গড়ে তুলতে হলে চাই ধর্মনিরপেক্ষ–বৈজ্ঞা শিক্ষা৷ পশ্চিমবঙ্গের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন শিক্ষাপ্রেমী মানুষ অনেক প্রত্যাশা নিয়ে এমন পরামর্শই দিচ্ছেন, প্রত্যাশা পূরণের দায়িত্ব যিনি পরামর্শ চেয়েছেন তাঁর৷