বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে সম্প্রতি রাজ্যপাল এবং শিক্ষামন্ত্রী সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে পরস্পরের প্রতি যে অশালীন ভাষায় কথা বলছেন, যে শরীরী ভাষা প্রয়োগ করছেন, যে ধমকি-হুমকি একে অপরকে দিচ্ছেন, তা রাজ্যের শিক্ষার পরিবেশকে কলুষিত করছে। এর বিরুদ্ধে এবং জাতীয় শিক্ষানীতির কার্বন কপি রাজ্য শিক্ষানীতি কার্যকর করার বিরুদ্ধে এসইউসিআই(সি) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির উদ্যোগে ১৪ সেপ্টেম্বর কলকাতা ও শিলিগুড়িতে বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত হয়।
কলকাতায় কলেজ স্কোয়ারে এক সভায় বক্তব্য রাখেন রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, প্রাক্তন সাংসদ ডাঃ তরুণ মণ্ডল, প্রাক্তন বিধায়ক অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। সভাপতিত্ব করেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক অনুরূপা দাস। কলেজ স্কোয়ার থেকে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ পর্যন্ত মিছিলে দু’হাজারের বেশি মানুষ উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন রাজ্যপাল ও শিক্ষামন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়ে কিছু দাবি তুলে ধরা হয়। শিলিগুড়ির বাঘাযতীন পার্কে সংক্ষিপ্ত সভার পর সেখান থেকে একটি সুসজ্জিত মিছিল শহর পরিক্রমা করে এয়ারভিউ মোড়ে শেষ হয়। নেতৃত্ব দেন দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড শিশির সরকার, রাজ্য কমিটির সদস্য এবং দার্জিলিং জেলা সম্পাদক কমরেড গৌতম ভট্টাচার্য, রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড অসিত দে, অমল রায়, তন্ময় দত্ত প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আচার্য হিসেবে রাজ্যপালের ভূমিকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনেই নির্দিষ্ট রয়েছে। সেই আইনকে অমান্য করে রাজ্যপাল নিজের পছন্দমতো ব্যক্তিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করছেন– কখনও প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতাহীন অধ্যাপক, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারকে রাজ্যপাল উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ করছেন। তাঁর কি জানা নেই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ বছর অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা ছাড়া উপাযার্য হওয়া যায় না। শিক্ষার স্বার্থের পরিবর্তে বিজেপির স্বার্থরক্ষায়বদ্ধপরিকর রাজ্যপাল রাজ্য সরকারের সাথে পরামর্শ না করে মাঝরাতে চিঠি পাঠিয়েও উপাচার্য নিয়োগ করেছেন। এমনকি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতামতও চাওয়া হয়নি। আচার্য হয়েও রাজ্যপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের মান্যতা দেননি।
যদিও রাজ্যপাল উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম ভাঙার় সুযোগ পাচ্ছেন তৃণমূল সরকারের ভূমিকায়। তৃণমূল সরকার রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত আইনের একের পর এক যে সংশোধনীগুলি বিধানসভায় পাশ করেছে, তারই সুযোগ নিয়ে রাজ্যপাল এরকম বেপরোয়া স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পেরেছেন। স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের জন্য ‘সার্চ’ কমিটি গঠনের আইন সংশোধন করতে গিয়ে ইউজিসি-র নিয়ম লঙ্ঘন করেছে রাজ্য সরকার। সংশোধিত আইন এমন হয়েছে যে, তৃণমূল সরকারের পছন্দের ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ উপাচার্য হতে পারবেন না। এমনকি রাজ্য সরকার মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিধানসভায় বিল এনে রাজ্যপালের পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে বসানোর ব্যবস্থা করেছে। ফলে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে বদ্ধপরিকর রাজ্যপাল এবং রাজ্য সরকার দুই পক্ষই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কার দখল থাকবে– তা নিয়ে দু’পক্ষের অগণতান্ত্রিক ও অশোভন প্রতিযোগিতায় শিক্ষাক্ষেত্রের সমূহ সর্বনাশ হচ্ছে, ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের। রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সংঘাত এমন পর্যায়ে গেছে যে সুপ্রিম কোর্ট ‘সার্চ’ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
বক্তারা আরও বলেন, কোনও রাজনৈতিক নেতা, মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যপাল নন, উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনও শিক্ষাবিদকে আচার্য হিসেবে নিয়োগ করা হোক, যিনি শিক্ষার্থীদের ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে পারবেন। এ ছাড়া জাতীয় শিক্ষানীতি চালু করার মধ্য দিয়ে বিজেপি গোটা দেশে শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ করে দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েমের উদ্দেশ্যে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোথাও প্রতিনিধি নির্বাচন করছে না। রাজ্যের তৃণমূল সরকারও এই নীতিতে সিলমোহর লাগিয়েছে। তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা বডি থেকে শুরু করে ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন করছে না। এস ইউ সি আই (সি)-র দাবি অবিলম্বে সমস্ত স্তরে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতি এবং তার কার্বন কপি রাজ্য শিক্ষানীতিকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
তরুণকান্তি নস্করের নেতৃত্বে ৪ জনের প্রতিনিধিদল রাজ্যপালের দপ্তরে স্মারকলিপি দেয়। অন্যদিকে তরুণ মণ্ডলের নেতৃত্বে ৪ জনের প্রতিনিধিদল বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে দাবিপত্র দেয়। মন্ত্রী প্রতিনিধিদলকে বলেন, ৮২০৭টি স্কুল যাতে না উঠে যায় তিনি তার চেষ্টা করবেন, অষ্টম শ্রেণি থেকে সেমিস্টার চালু করা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন– পাশ-ফেল নেই, তাই সেমিস্টারে মূল্যায়ন হবে, দশম শ্রেণির পরীক্ষা থাকবে।
মন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সিলেবাস কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক অভীক মজুমদার। শিক্ষামন্ত্রী রাজ্য শিক্ষানীতি সম্পর্কে দলের লিখিত মতামত চেয়েছেন এবং প্রয়োজনে কমিটির সাথে দলের প্রতিনিধিদের বৈঠকের ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন। স্মারকলিপিটি খোলা চিঠি আকারে রাজ্যের সর্বত্র জনসাধারণের উদ্দেশে প্রচার করা হয়েছে।