শিক্ষক নিয়োগের মূল দাবিই গুলিয়ে দিচ্ছে বিজেপি–তৃণমূলের ভোট রাজনীতি

ফাইল চিত্র

২০ সেপ্টেম্বর উত্তর দিনাজপুর জেলার দাড়িভিট হাইস্কুলে ছাত্র–ছাত্রী এবং স্থানীয় মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন কেন? কেন তারা স্কুল ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন? এই বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে গুলিতে দুই তরতাজা  ছাত্রের মৃত্যু সারা রাজ্যের মানুষকে ব্যথিত করেছে৷ মর্মাহত মানুষের প্রশ্ন, স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের মতো বিষয়ে বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে যেতে হচ্ছে, এমন পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হবে না কেন? কেনই বা বিচক্ষণতা, ধৈর্য এবং সহানুভূতির সাথে ছাত্র বিক্ষোভ সামলানোর বদলে পুলিশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে বলপ্রয়োগের রাস্তায় গেল? এর জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের শাস্তি হবে না কেন?

দাড়িভিটের ছাত্র–ভিভাবক, সাধারণ মানুষের দাবি কী ছিল? পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল এবং কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপির চাপান–উতোরে সেটাই গুলিয়ে যাচ্ছে৷ স্কুলটিতে ছাত্র সংখ্যা প্রায় ১৮০০,  সরকারি হিসাবেই যত শিক্ষক সেখানে থাকার কথা তার থেকে কম আছেন ২১ জন৷ এই স্কুলটিতে মূলত গরিব পরিবারের ছাত্র–ছাত্রীরা পড়ে৷ যাদের পড়াশোনার জন্য স্কুলই ভরসা৷ প্রচুর টাকা দিয়ে প্রাইভেট টিউশন নির্ভর শিক্ষা তাদের কাছে স্বপ্ন৷ তাই স্কুলে শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ চেয়ে এলাকাবাসী বারবার আর্জি জানিয়েছেন৷ স্কুল কর্তৃপক্ষও ২০১২ সাল থেকে এই আর্জি জানিয়েছেন৷ অথচ দেখা গেল যখন দু’জন শিক্ষক কাজে যোগ দিতে এলেন দাড়িভিট হাইস্কুলের বিক্ষোভকারীরা তাঁদের ফিরে যেতে বাধ্য করলেন৷ বাস্তবে স্বজনপোষণ এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জটিল সমীকরণ মেলাতে গিয়ে শিক্ষক নিয়োগের নামে ছাত্র–ছাত্রীদের সাথে প্রতারণা করেছে সরকার৷

এই বিষয়টিকে চাপা দিতে তৃণমূল কংগ্রেসের মহল থেকে প্রচার করা হচ্ছে দাড়িভিট হাই স্কুলের ছাত্র–ছাত্রীরা শিক্ষক নিয়োগের মতো একান্ত প্রশাসনিক বিষয়েও মাথা গলাতে গিয়েই এই গন্ডগোল ডেকে এনেছেন৷ অন্যদিকে বিজেপি সুযোগ বুঝে ভোট রাজনীতিতে ফয়দা তুলতে অত্যন্ত বিপজ্জনক সাম্প্রদায়িক সেন্টিমেন্ট ছড়াচ্ছে৷ তারা রব তুলেছে– উর্দু নয় বাংলা চাই৷ যেন দাড়িভিটের আন্দোলনে এটাই ছিল দাবি!

যদিও নিজেদের দাবিটা খুব পরিষ্কার ভাষায় দাড়িভিটের মানুষ রেখেছেন৷ স্কুলে পর্যাপ্ত সংখ্যায় শিক্ষক চাই৷ ওই স্কুলের প্রথম প্রয়োজন ছিল উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বাংলা ও ভূগোলের শিক্ষক৷ তারপর ধীরে ধীরে অন্য বিষয়ের শিক্ষক পদ পূরণ৷ অথচ রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তর, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, স্কুল সার্ভিস কমিশন, জেলার বিদ্যালয় পরিদর্শক বা ডিআই ইত্যাদি রথী–মহারথীরা মিলে ওই স্কুলে একজন উর্দু ও একজন সংস্কৃত ভাষার শিক্ষককে কাজে যোগ দিতে পাঠিয়েছিলেন৷ যদিও ওই স্কুলে উচ্চমাধ্যমিকে এই দুটি বিষয়ে কোনও শিক্ষক পদ আদৌ খালি নেই৷ প্রথম দিন স্কুল কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় এই দুজনকে কাজে যোগ দিতে দেওয়া যাবে না৷ অথচ ঠিক পরের দিন জেলার ডিআইয়ের উপস্থিতিতে তারা মাধ্যমিক স্তরের খালি দুটি পোস্টকে উচ্চমাধ্যমিকে পরিবর্তন (কনভার্সান) করে ওই দুজনের যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়৷ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী এখন বলছেন, নতুন আইনে নাকি এই ধরনের কনভার্সানের অধিকার ডিআইয়ের হাতে নেই৷ কিন্তু নানা জেলার ডিআইদের বক্তব্য এই ধরনের কনভার্সান তাঁরা হামেশাই করে থাকেন৷ শিক্ষা দপ্তরের আইনের খবর ডিআইরাই রাখেন না এটা কি বাস্তব সত্য নাকি দরকার মতো আইনকে দুমড়ে–মুচড়ে নিজেদের সুবিধামতো করে নেওয়ার শাসকদলীয় প্রথারই বহিঃপ্রকাশ এটা যখন দরকার তখন ইচ্ছামতো পোস্ট তৈরি হচ্ছে, আবার বিপদে পড়লে তা বেমালুম বেআইনি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে, উর্দু বনাম বাংলা এমন বিরোধ দাড়িভিটে ঘটেনি৷ বিজেপি সাম্প্রদায়িক রঙ চড়িয়ে অত্যন্ত জঘন্য পরিকল্পনা নিয়েই এই ধরনের কথা তুলেছে৷ বিজেপির কথা সত্যি হলে সংস্কৃতের বিরুদ্ধেও তো স্লোগান দিতে হয় বিজেপি উর্দুর কথা বলল, আর সংস্কৃতটা চেপে গেল কোন উদ্দেশ্যে? দাড়িভিটের মানুষের স্বার্থেই যদি বিজেপি আন্দোলন করত, তাহলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানার চেষ্টার বদলে এলাকার মানুষের শিক্ষার দাবিটাকেই তারা গুরুত্ব দিত৷ কিন্তু ভোটের উদগ্র লালসায় তারা সে পথে হাঁটেনি৷ বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে গুলিতে দুই ছাত্রের হত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনাকে এভাবে সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করার মতো দুষ্ট রাজনীতি মানুষকে কী দেবে?

দাড়িভিটের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে স্কুলশিক্ষা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কী চলছে মাধ্যমিক–উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক–শিক্ষক কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় ৭০ হাজার পদ খালি৷ এর মধ্যে শিক্ষক পদই ৬০ হাজারের বেশি৷ (সূত্র : মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি–এসটিইএ) তৃণমূল কংগ্রেস সরকারে বসার পর ২০১২ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের হাত ধরে কিছু শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল৷ তারপর থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ৬ বছর এসএসসির মাধ্যমে কার্যত আর নতুন শিক্ষক নিয়োগ হয়নি৷ সম্প্রতি এসএসসি–র মাধ্যমে কিছু কিছু নিয়োগ শুরু হয়েছে৷ তাতেও দেখা যাচ্ছে জেলায় জেলায় শূন্য পদের তালিকার কোনও ঠিকঠিকানা নেই৷ দাড়িভিট স্কুলই ২১ জন শিক্ষকের অভাবের কথা জানালেও এসএসসির ওয়েবসাইটে তাদের মাত্র ৫ জন শিক্ষকের পদ খালি বলে দেখানো হয়েছে৷ বিভিন্ন জেলায় এভাবেই শূন্য পদ স্রেফ গায়েব করে দিয়েছে সরকার৷ অনুমোদিত পদের সংখ্যা নিয়েও চরম অস্বচ্ছতা তৈরি করা হচ্ছে৷ এর সুযোগে চলছে দলবাজি, স্বজনপোষণ, আর ঘুষের কারবারের রমরমা৷ কোনও চাকরিপ্রার্থী এসএসসি–র ওয়েবসাইট দেখে হদিশই পাচ্ছেন না কোন স্কুলে পোস্ট খালি আছে, তিনি কোথায় পোস্টিং চাইবেন অথচ পিছনের দরজা দিয়ে টাকা, দলীয় হুকুম অথবা খুঁটির জোরে অনুমোদনহীন পোস্টকে কোথাও কোথাও অনুমোদনের মোড়ক দিয়ে নিয়োগ হয়ে যাচ্ছে৷ দাড়িভিটেও তাই হয়েছে৷ সে জন্যই ছাত্র–ভিভাবকদের ন্যায্য দাবি তথা স্কুলের যথার্থ প্রয়োজনকে দু’পায়ে মাড়িয়ে তড়িঘড়ি স্কুল কমিটির সিদ্ধান্ত বদলে সংস্কৃত আর উর্দু  শিক্ষক নিয়োগের রাস্তা খোলা হয়েছে৷ এক্ষেত্রে আবার শাসকদলের এক বিধায়ক তথা মন্ত্রীর সাথে একই দলের স্থানীয় বিধায়কের স্বার্থের দ্বন্দ্বে বিষয়টা জটিল হয়ে গেছে৷

স্কুল শিক্ষা নিয়ে এই খেলার সবচেয়ে বড় মূল্য দিচ্ছে রাজ্যের স্কুল ছাত্ররা৷ একদিকে  জেলাগুলিতে উপযুক্ত সংখ্যায় শিক্ষক না থাকায় বহু স্কুলে বিভিন্ন ক্লাস মিলিয়ে পড়ানো চলে৷ ফলে ছাত্র–শিক্ষক কারও পক্ষেই ক্লাসে শিক্ষা গ্রহণ বা দান কোনওটিই সম্ভব হয় না৷ অন্যদিকে পরিকাঠামোহীন স্কুলগুলিতে দীর্ঘদিন পাশ–ফেল প্রথাহীন শিক্ষার প্রহসন চলায় কলকাতার মতো বড় শহরগুলিতে সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে ছাত্র–ছাত্রী কমতে কমতে একেবারেই শেষ অবস্থায় পৌঁ‍ছেছে৷ রমরমা বেড়েছে বেসরকারি স্কুলের৷ বহু মফঃস্বলেও এই লক্ষণ এখন ফুটে উঠছে৷

দাড়িভিটের আন্দোলন এবং দুই ছাত্রের মর্মান্তিক হত্যা একদিকে রাজ্য জুড়ে স্কুলশিক্ষায় বিপর্যয়কর পরিস্থিতিকে বেআব্রু করে দিয়েছে৷ অন্যদিকে বিজেপি এবং তৃণমূলের মতো ভোটবাজ দলগুলির নোংরা রাজনীতিকেও সামনে এনেছে৷ শিক্ষাবিদ–শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রেমী জনসাধারণের সচেতন সংঘবদ্ধ প্রয়াস ও লাগাতার আন্দোলন ছাড়া এর প্রতিকার অসম্ভব৷

(৭১ বর্ষ ১০ সংখ্যা ৫ -১১ অক্টোবর, ২০১৮)