শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিরাট কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে বর্তমান শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী, পূর্বতন শিক্ষামন্ত্রী সিবিআই দফতরে হাজিরা দিচ্ছেন। শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নিজে তাঁর কন্যার বেআইনি নিয়োগের দায়ে অভিযুক্ত। ছশোর বেশি নিয়োগ ইতিমধ্যে বাতিল বলে ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসংগঠন এআইডিএসও, যুবসংগঠন এআইডিওয়াইও ২০ মে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখায়। এসইউসিআই (সি) ২৪ মে বিকাশভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখায় এবং স্মারকলিপি দিয়ে দোষীদের শাস্তির দাবি জানায়। উভয় ক্ষেত্রেই পুলিশের বাধা মোকাবিলা করে বিক্ষোভ চলে। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কাছে ৫০ জন ছাত্র-যুব কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশি আক্রমণে ১০ জন আহত হন।
এর আগে ২০১২ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা টেট নিয়ে কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এলেও তার সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি। কোনও নেতা মন্ত্রী বা আমলার বিরুদ্ধে কোনও রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এরপর ২০১৪ সালে প্রাথমিক স্কুলে নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি বের হয়। এই পরীক্ষাতেও দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের তৎকালীন এক বিধায়ক প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ২০১৪তে তিনি তাঁর স্ত্রী, বৌদি সমেত ৬২ জনকে প্রাইমারি স্কুলের চাকরি নিয়ম ভেঙে পাইয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি আরও বেশ কয়েকজন তৃণমূল মন্ত্রী, বিধায়ক জেলাসভাপতির নাম করে বলেছিলেন, যারা অনেককে পিছনের দরজা দিয়ে প্রাইমারি শিক্ষকের চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। অবশ্যই তা মোটা টাকা লেনদেনের বিনিময়ে।
কিছুদিন আগে রাজ্য সরকার এসএসসি পরীক্ষায় রিজিওনাল লেভেল সিলেকশন টেস্ট-এর বদলে স্টেট লেভেল সিলেকশন টেস্ট ব্যবস্থা আনে। এসএলএসটি-র নিয়োগের প্যানেলও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। শুধুমাত্র শিক্ষক নিয়োগেই নয় গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি নিয়োগেও দুর্নীতি সামনে এসেছে। এসএসসির গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি, এসএলএসটি সহ দুর্নীতির মোট সাতটি মামলায় প্রাথমিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় দুর্নীতি যাচাইয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশও দেন। গ্রুপ ডি ও গ্রুপ সি পদে যথাক্রমে ৫৭৩ এবং ৩৫০ জনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত ও বেতন বন্ধের নির্দেশ দেন। পরবর্তীকালে ডিভিশন বেঞ্চসেই রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দিয়ে প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটির উপর তদন্তভার তুলে দেয়।
বাগ কমিটির রিপোর্টে দুর্নীতির এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। রিপোর্টে জানা গেছে গ্রুপ ডিতে ৬০৯ জনকে বেআইনিভাবে নিয়োগ করা হয়েছে। এই ধরনের নিয়োগে সম্পূর্ণ প্যানেল বা মেধাতালিকা প্রকাশ করত না এসএসসি। রিপোর্ট বলছে এই তালিকা ভুয়ো, পছন্দমত নাম ঢুকিয়ে তৈরি করা। এসএসসি-র সুপারিশ করা তালিকা অনুসারে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ নিয়োগপত্র দেয়। কমিটির রিপোর্ট বলছে, এই বছর থেকে এসএসসি-র তালিকায় আধিকারিকদের নিজের হাতের স্বাক্ষরের বদলে চালু হয় ডিজিটাল স্বাক্ষর। এর পিছনেও পর্ষদের কিছু কর্তার মদত ছিল। নিয়ম অনুযায়ী এসএসসি পাঁচটি আঞ্চলিক অফিস থেকে সফল পরীক্ষার্থীদের নাম সুপারিশ করা হয়। তারপর তাতে সিলমোহর দেয় প্রধান অফিস। অভিযোগ এই নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকৃত প্রাপকরা বঞ্চিত হয়েছেন। অভিযোগ আঞ্চলিক অফিস থেকে সঠিক নাম এলেও মূল অফিসে এসে তা বদলে গিয়েছে। সুপারিশপত্রে আঞ্চলিক অফিসের চেয়ারম্যানদের সই জাল করে এই কাজ করা হয়েছে। প্যানেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পর নিয়ম ভেঙে ৩৮১ জনকে চাকরির সুপারিশ পত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় পাস না করা ২২২ জনকে এসএসসি অফিস থেকে সুপারিশপত্র দেওয়া হয়েছিল। বাগ কমিটি এই নিয়োগ দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড হিসাবে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আমলে গঠিত ৫ জনের ‘নজরদারি’ কমিটিকে চিহ্নিত করেছে। এই কমিটির বুদ্ধিতে তৈরি হয়েছিল অবৈধ নিয়োগের কৌশল। জাল হয়েছে সুপারিশপত্রের সই, পোড়ানো হয়েছে ওএমআর শিট, ডিলিট করা হয়েছে কম্পিউটারের সমস্ত ডেটা। বাদ যায়নি স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সহ আধিকারিকদের নামও। এমনকি মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতির নামও এই তালিকায় আছে। কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী সুপারিশপত্রগুলি এসএসসি ‘উপদেষ্টা’ শান্তি প্রসাদ সিনহা নিজে পর্ষদ সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়েছিলেন। এই নিয়োগপত্রগুলি পর্ষদের অফিস থেকে না দিয়ে এসএসসি-র নবনির্মিত ভবন থেকে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিচারপতি বাগ কমিটি। এমনকি লেনদেনের হিসাব নিকাশ করার জন্য ছিল আলাদা রেজিস্টার। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল স্কুল সার্ভিস কমিশন একটি স্বশাসিত সংস্থা। তার উপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য অন্য কোনও ধরনের় নজরদারি কমিটি গঠন চূড়ান্ত বেআইনি।
বাগ কমিটির রিপোর্টে ছত্রে ছত্রে এই বেআইনি বিষয় বেরিয়ে আসার পরও মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে কার্যত সেই সমস্ত দুর্নীতিবাজদের আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেবার মাস তিনেকের মধ্যেই বর্তমান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারী ইন্টারভিউতে না বসেই এসএলএসটি-র মেধাতালিকার ওয়েটিং লিস্টের এক নম্বরে স্থান পেয়ে যান।
শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি আমাদের দেশে বা রাজ্যে এটাই প্রথম নয়। রাজ্যে পূর্বতন কংগ্রেস সরকার, তারপর সিপিএম সরকারের আমলে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত একটা সময় ছিল যখন ম্যানেজিং কমিটির হাত ধরে নেতা ও মন্ত্রীদের বাড়ির লোকেরা, আত্মীয়-স্বজনরা ও শাসক দলের কর্মীরাই স্কুলে শিক্ষকের চাকরি পেয়ে যেত। এর জন্য বহু ক্ষেত্রে দিতে হত মোটা টাকার ডোনেশন। ফলে বঞ্চিত হত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা। শুধু এই রাজ্য নয় ত্রিপুরাতেও কংগ্রেস আমলে দুর্নীতি হয়েছে। পরে সিপিএমের আমলে ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে শুধুমাত্র মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে নিযুক্ত ১০,৩২৩ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল করে সে রাজ্যের হাইকোর্ট স্বচ্ছতা ও মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছিল। ১৯৯৭-এর এপ্রিল মাসে পশ্চিমবঙ্গে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) তৈরি করার পিছনে সিপিএম সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল এই নিয়োগকে কেন্দ্রীয় ভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা। স্কুলের নিয়োগে দুর্নীতি লাগামছাড়া হওয়ায় স্বচ্ছতার একটা প্রলেপ দেওয়াও তাদের তখন দরকার ছিল। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমিশনই শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের পরীক্ষা নিয়ে এসেছে।
২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর একেবারে শিক্ষকতা এবং অন্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগে খোলাখুলি দুর্নীতি শুরু করে। সাংবিধানিক সংস্থা পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে (পিএসসি) পর্যন্ত পঙ্গু করে দেওয়া হয়। রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ অফিসার নিয়োগের ডব্লুবিসিএস পরীক্ষাতেও পিএসসি-র বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে ভুরিভুরি।
এই দুর্নীতির উৎস কোথায়? ভারতে ক্ষমতাসীন এমন কোনও দল নেই, যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারে কংগ্রেস, বিজেপি বা অন্য কোনও দল, যেই থাক বারবার দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়েছে। কংগ্রেসের বোফর্স কেলেঙ্কারি, চিনি কেলেঙ্কারি বা কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি, শেয়ার কেলেঙ্কারি, মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারের ব্যাপম কেলেঙ্কারির কথা সবাই জানে। সম্প্রতি কর্নাটকে এক কনট্রাক্টর বিজেপির এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কাটমানি চাওয়ার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ তুলেছিলেন এবং ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’ স্লোগানের প্রবক্তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জানিয়েও কোনও প্রতিকার না পেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। এমন উদাহরণ অসংখ্য। কিন্তু এর থেকে বেরোবার পথ কী? দুর্নীতি রোধ কি কোনওভাবেই সম্ভব নয়?
এ কথা ঠিক, যেমন চাহিদা, সেই অনুপাতে চাকরির সুযোগ থাকলে এই দুর্নীতির চিন্তা, ঘুষ দেওয়া বা নেওয়ার চিন্তা জন্ম নেওয়ার জমি আদৌ পেত না। আজ সরকারের সংস্কার নীতির ফলে চাকরির পোস্ট বিলুপ্ত হচ্ছে। গত ছয় বছরে রেলে ৫৬ হাজারের বেশি পদ ছাঁটাই করা হচ্ছে। এমনি অবস্থা সর্বত্র। শিল্পায়নও থমকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্যই। চাকরির ভীষণ সংঘর্ষ। এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিজেই চরম অনৈতিকতার উপর, অন্যায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তাকে যারা রক্ষণাবেক্ষণ করছে, দুর্নীতির বাইরে তারা থাকবে কীভাবে? আজ দুর্নীতি দূর করার সংগ্রাম তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নির্মূল করার সংগ্রামের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে।
গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ২৭ মে ২০২২