রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে এসএসসি-র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ এবং গ্রুপ-সি ও গ্রুপ-ডি কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়। এ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হয়েছে এবং বিচারকের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত শুরু হয়েছে। এই মামলায় বিচারপতির বিভিন্ন নির্দেশের বিরুদ্ধে তৃণমূল সমর্থক একদল আইনজীবী কোর্টে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। অন্যদিকে সিবিআই, যাকে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল ‘খাঁচার তোতা’, তারা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্তাদের প্রভাব এড়িয়ে কতটা স্বাধীনভাবে তদন্ত প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করতে পারবে, না কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে–এই আশঙ্কাও রয়েছে। মানুষ চাইছে সত্য বেরিয়ে আসুক, অপরাধী সাজা পাক। সাথে সাথে মানুষের মনে যে প্রশ্নটি ধাক্কা দিচ্ছে তা হল, দুর্নীতি কি তবে সব সরকারের মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়াল? এর থেকে বেরোনোর কি কোনও উপায় নেই?
সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে নবম-দশম শ্রেণির জন্য শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির এই অভিযোগ। সংবাদে প্রকাশ, ৭২ রকম দুর্নীতি বা অনিয়ম নাকি হয়েছে! তার মধ্যে রয়েছে বেশি নম্বর পাওয়া প্রার্থীকে টপকে কম নম্বর পাওয়া প্রার্থীকে নিয়োগপত্র দেওয়া। আরও অভিযোগ উঠেছে গ্রুপ-সি ও গ্রুপ-ডি-তে নিয়োগের ক্ষেত্রে চাকরির পরীক্ষায় পাশও করেনি, এমন সব প্রার্থীদের নিয়োগ করা হয়েছে। এর পিছনে কোটি কোটি টাকা ঘুষের কারবারের অভিযোগও আছে। এবারই প্রথম নয়, কয়েক বছর আগে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও তাদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ১১ বছরের শাসনে কোটি কোটি টাকার সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়েছে। নারদা স্টিং অপারেশনে তাদের কয়েকজন সাংসদকে কোটি কোটি টাকার ঘুষ দেওয়ার ছবিও সংবাদমাধ্যমে এসেছে। কলকাতার রাস্তায় ত্রিফলা ল্যাম্প বসানোকে কেন্দ্র করেও তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। এগুলি ছাড়াও আঞ্চলিক স্তরে নানা দুর্নীতি চলছে। ১০০ দিনের কাজ নিয়ে দুর্নীতি, আবাস যোজনায় ঘর বরাদ্দ করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি সর্বত্র চলছে। নদীবাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে। পঞ্চায়েত ও পৌরসভায় ঘুষ না দিলে, কাটমানি না দিলে বহু ক্ষেত্রে কাজই হয় না। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। তাদের পরিচালিত সিন্ডিকেট-রাজের দাপট রাজ্যের জনজীবনে একটা ত্রাসের মতো দেখা দিয়েছে। আর আঞ্চলিক স্তরেও তাদের বড়-ছোট-মেজো নেতাদের হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছে। হঠাৎ ধনী হয়ে কীভাবে রাজকীয় প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন তৃণমূলের বিভিন্ন নেতা, এখন তার নানা প্রতিবেদন সংবাদপত্রে দেখা যাচ্ছে।
এই দুর্নীতির ফলে বঞ্চিত প্রার্থীরা, যাঁদের অনেকেই প্যানেলভুক্ত হয়েও চাকরি পাননি, তাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতির কথা জানা মাত্রই পথে নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছে এস ইউ সি আই (সি)। যুব সংগঠন এ আই ডি ওয়াই ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে মিছিল করেছে, বিক্ষোভ দেখিয়েছে। পক্ষপাতমুক্ত তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
কিছু রাজনৈতিক দলও এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলছে। কিন্তু অদ্ভূতভাবে দেখা যায়, এই সব দল কিছু দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব, আবার কিছু দুর্নীতি দেখেও দেখতে পায় না। যে বিজেপি এ রাজ্যে তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলছে, বিবৃতি দিচ্ছে, সে কিন্তু একটি বারও অন্যান্য রাজ্যে দুর্নীতির প্রসঙ্গ আনছে না। অথচ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে দুর্নীতির চেহারা কী? মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের আমলে ‘ব্যাপম কেলেঙ্কারি’ ভারতের বৃহত্তম দুর্নীতিগুলির অন্যতম। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, নানা সরকারি চাকরি, ব্যাঙ্ক, শিক্ষক, পুলিশ সহ বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগের পরীক্ষা হয় এই ব্যাপমের মাধ্যমে। এই বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ, লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বোর্ড কর্তারা অযোগ্য প্রার্থীদের ভর্তি করিয়েছেন এবং চাকরি দিয়েছেন। অন্যদিকে কংগ্রেসের দুর্নীতিও ভুরি ভুরি। শত শত কোটি টাকার হাওয়ালা কেলেঙ্কারি, বোফর্স কামান কেলেঙ্কারি, টেলিকম কেলেঙ্কারি, কয়লা কেলেঙ্কারি সহ কত দুর্নীতি রয়েছে তালিকায়। সিপিএম আমলে দুর্নীতি কেমন ছিল? সিপিএম আমলের প্রথম দিকে শিক্ষক নিয়োগ হত ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে। সেখানেও লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে কম নম্বরের প্রার্থীরা নিয়োগপত্র পেয়ে যেত অনায়াসেই। যোগ্য প্রার্থীদের নানা ছল চাতুরির আশ্রয়ে ইন্টারভিউতে বহুক্ষেত্রে আসতেই দেওয়া হত না। দলবাজি, স্বজন-পোষণ মারাত্মক রূপ নিয়েছিল। ভুক্তভোগী মানুষ এ সব জানেন। ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে মানুষ যে সিপিএম সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিল, তার অন্যতম ক্ষোভের কারণ ছিল এই জায়গায়। মানুষ এর পরিবর্তন চাইছিল। কিন্তু শাসন ক্ষমতায় পরিবর্তন এলেও দুর্নীতির বন্যায় বাঁধ পড়েনি। তৃণমূল সরকারের এই নিয়োগ দুর্নীতি সেই তালিকায় নবতম সংযোজন।
মার্কসবাদী বিজ্ঞান বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই দুর্নীতির আঁতুড় ঘর। কিন্তু তার দ্বারা এটা বোঝায় না এই ব্যবস্থার মধ্যে থাকলেই সকলে দুর্নীতিগ্রস্ত হবে। কারা দুর্নীতিগ্রস্ত হবে? যারা এই শোষণমূলক ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ বা তদারকির দায়িত্বে থাকবে, সেই রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক হবে তার অংশীদার হবে, তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হবেই। নীতিহীন রাজনীতির রাস্তায় থাকলে অনৈতিক পথে যে কোনও উপায়ে সম্পদ বৃদ্ধি করা জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয়ে উঠবে। দুর্নীতি মুক্ত থাকতে গেলে, দুর্নীতিকে রুখতে গেলে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আন্দোলনের শরিক হওয়া আজ অত্যন্ত জরুরি।