স্যার/কমরেড,
আপনাকে নিয়ে যত বড়ই লিখি সেটা আমার কাছে অতি নগণ্য। তখন আমি সবে ক্লাস নাইন। আমার জীবনে ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও এবং এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলটার নাম শোনা ও সেই সংগঠনের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার প্রথম প্রধান কারিগর হলেন আপনি। আমরা জানি মানুষ গড়ার কারিগর হলেন শিক্ষক, আর তা একটা একটা করে আপনি বাস্তবে গড়েছেন।
আপনার দেখানো পথে আজও আমরা রাস্তায় আছি। আপনি টিউশনি করতে করতেই ভগৎ সিং, ক্ষুদিরামদের কথা বলতেন, বলতেন নেতাজি, নজরুলের কথা। শরৎচন্দ্র-বিদ্যাসাগরের গল্প বলতেন। আমার মতোই কত-শত (হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই কত-শত) কিশোর-কিশোরী, যুবক যুবতীর মনে লেনিন হওয়ার রঙিন স্বপ্ন এঁকেছিলেন। গল্পের ছলে আপনি শোনাতেন মাও সে তুং-এর কথা। তার মধ্যেই এঁকে দিতেন কমরেড শিবদাস ঘোষের নাম, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর আদর্শ। আমরা বিভোর হয়ে শুনতাম আর রূপকথার মতোই স্বপ্নরাজ্যে পাড়ি দিতাম।
তখন রাজনীতি তেমন ভাবে না বুঝলেও বিড়বিড় করে বলতাম, ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন’। এ ভাবেই একটা সময় অনেকের মতোই আমিও সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের আদর্শ বুকে ধারণ করে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের কাজের সাথে যুক্ত হয়ে গেলাম আপনার দেখানো পথেই। যখন দলের দায়িত্ব পালন করতে লাগলাম তখন আপনি গর্ব অনুভব করতেন। দলের কাজের জন্য বহরমপুরে থাকার সুবাদে হয়তো শেষ দিকে দেখা সাক্ষাৎ কম হত, কিন্তু যোগাযোগ প্রতিনিয়ত নিবিড়ভাবেই ছিল।
মাস তিনেক আগে শেষবারের মতো আপনার সাথে কথা হয় ফোনে। আর ১১ মে যখন হাসপাতালে আপনাকে দেখতে গেলাম তখন আপনি কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন। দেখেই আমার চোখে জল এসে গেছে। আমাকে দেখেই হাত দু’খানা ধরে যেন বুকে টেনে নিতে চাইছিলেন। ছাড়তে চাইছিলেন না, আর বারবার ঠোঁট দুটো নাড়াচ্ছিলেন, যেন বলতে চাইছিলেন অরূপ আমি বাঁচতে চাই, ফিরতে চাই। কিন্তু কিছুই করার ছিল না আমাদের। চিকিৎসকরা চেষ্টা করেছেন।
আপনার অব্যক্ত কথা বলতে চাওয়া ঠোঁট দুটো যখন বারংবার কেঁপে উঠছে তখন মনে পড়ে যাচ্ছিল আপনার সেই দিনগুলির কথা, যে-দিন শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন এঁকে দিচ্ছিলেন আমার মতো অসংখ্য ছাত্রের বুকে। আপনি বলতেন লেনিন-স্ট্যালিনের রাশিয়ার কথা, যেখানে চিকিৎসা ছিল সার্বজনীন। অথচ আজ সেই সার্বজনীন চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি আমাদের দেশে থাকত তা হলে হয়তো মাত্র ৫৪ বছর বয়সে অকালে আমাদের ছেড়ে চলে যেতে হত না আপনাকে।
মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই হাসপাতালে ছুটলাম। রাত্রি প্রায় ন’টা থেকে আপনার প্রাণহীন দেহটার পাশে বসে থাকতে থাকতে আমারও চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, কেন আপনার মতো মানুষগুলো অকালে চলে যায়?
আপনার প্রাণ গেলেও আপনি বেঁচে থাকবেন আমার মধ্যে, আমাদের মধ্যে, অসংখ্য ছাত্রের মধ্যে। বেঁচে থাকবে আপনার দেখানো পথ, যে পথের পথিক আমরা।
লাল সেলাম কমরেড বিমলকৃষ্ণ দাস