শিক্ষকরা ছাত্রদের প্রতিবাদ করতে শেখালে সমাজের মঙ্গলই হবে

মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেন, ‘‘খবরের কাগজে দেখলাম, শিক্ষকরা বলছেন, স্ট্রাইক করবেন, কালো ব্যাজ পরবেন৷ তাঁদের থেকে কী শিখবে ছাত্রছাত্রীরা?’’ তখন হয়ত অনেকে ভাবেন, ছাত্রদের শেখা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কত উদ্বিগ্ন কিন্তু তারপরই তাঁরা যখন শোনেন– সেই অধ্যাপক–শিক্ষকদের পুলিশ লাঠিপেটা করেছে, গ্রেপ্তার করে লালবাজারে নিয়ে গিয়ে লকআপে ভরেছে৷ এমনকি শান্তিপূর্ণ অবস্থান ভাঙতে গিয়ে পুলিশ টান মেরে মহিলা শিক্ষকদের শাড়ি–ব্লাউজ ছিঁড়ে দিয়েছে, তখন সেই মানুষগুলি কী ভাবেন?

সম্প্রতি আংশিক সময়ের অধ্যাপকরা তাঁদের নানা দাবিতে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে অনশনের কর্মসূচি নিলে পুলিশ তা ভেঙে দিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে গারদে ভরে৷ তার ক’দিন আগে আংশিক সময়ের শিক্ষকদের অবস্থান রাতের অন্ধকারে নির্মম অত্যাচার চালিয়ে ভেঙে দেয় পুলিশ৷ এই প্রসঙ্গেই উপরোক্ত কথাগুলি বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷

কী দাবি অধ্যাপকদের? তাঁরা দীর্ঘদিন পূর্ণ সময়ের অধ্যাপকদের মতোই ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন৷ কলেজের সব দায়িত্বই পালন করছেন৷ বহু আন্দোলনের পরে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের স্থায়ীকরণের এবং বেতন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন৷ সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবিই তাঁরা তুলেছেন৷ আংশিক সময়ের শিক্ষকদের দাবিও তাই৷ এর মধ্যে অন্যায় বা বেআইনি কী আছে যে পুলিশ গোটা চত্ত্বর ঘিরে ফেলে অধ্যাপকদের টেনে–হিঁচড়ে গ্রেপ্তার করে লালবাজারে নিয়ে লকআপে ভরল? শিক্ষকদের অবস্থান ভাঙতে পুলিশ মহিলা শিক্ষকদের পোশাক ছিঁড়ে দিল৷ এ থেকে কী শিখবে ছাত্ররা?

অধ্যাপক–শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করাটা অন্যায়, নাকি তা পুলিশ দিয়ে ভেঙে দেওয়াটা অন্যায়? ছাত্রছাত্রীরা কোনটা থেকে খারাপ শিক্ষা পাবে? এটাই তো স্বাভাবিক যে, শিক্ষকদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখলে, ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করতে দেখলে ছাত্রছাত্রীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই শিখবে, দাবি যে লড়াই করে আদায় করে নিতে হয় সেই পাঠ নেবে৷ প্রতিবাদী শিক্ষকদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ যে অন্যায় এবং অমানবিক আচরণ করল তা থেকেই ছাত্রছাত্রীরা শিখবে যে, শিক্ষকরা তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্যটুকু সরকারের কাছে চাইলে তা না দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের লাঠিপেটা করেন, গারদে ভরেন৷ যে শিক্ষকরা জাতির মেরুদণ্ড বলে পরিচিত, মানুষ তৈরির কারিগর বলে পরিচিত তাঁদের ন্যূনতম মর্যাদাটুকু দেন না মুখ্যমন্ত্রী৷ শিখবে এটাই, যে মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী নেত্রী থাকার সময়ে রাজ্যে সিপিএম অপশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, দিনের পর দিন ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন৷ তিনিই এখন প্রতিবাদ দেখলে, আন্দোলন দেখলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, পুলিশ দিয়ে অত্যাচার চালিয়ে তা ভেঙে দেন, ধর্মঘট নিষিদ্ধ করেন৷ ক্ষমতায় না থাকলে এক আচরণ, আর ক্ষমতার গদিতে গিয়ে বসলে সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ– ছাত্রছাত্রীরা যত সরলমতিই হোক, একে ভণ্ডামি এবং দ্বিচারিতা বলে চিনতে তাদের অসুবিধা হবে কি? তা ছাড়া তিনি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সত্যিই কি চিন্তিত? তা হলে তো ছাত্রদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে যে কারণে সেই পাশ–ফেল প্রথা না থাকা, সেটাই তো সবার আগে চালু করতেন৷ রাজ্যের মানুষ জানেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েও এ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে টালবাহনা করে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছেন৷

মুখ্যমন্ত্রীর অপছন্দ হলেও দেশের শিক্ষকরা যদি সত্যিই ছাত্র–ছাত্রীদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে, তার বিরুদ্ধে লড়তে, আন্দোলন করতে শিখিয়ে দেন তবে তা যথার্থই সমাজের মঙ্গল ডেকে আনবে৷ আজ সমাজের এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে কোনও না কোনও অন্যায় ঘটছে না৷ একদিকে পুঁজিবাদী শোষণ–নিপীড়ন, অন্য দিকে তাদের সেবাদাস হিসাবে সরকারগুলি জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে করের বোঝা, মূল্যবৃদ্ধির বোঝা, কেড়ে নিচ্ছে শিক্ষা–স্বাস্থ্যের অধিকার৷ মালিকদের দেদার লাইসেন্স দিয়ে দিচ্ছে ছাঁটাই, লক–আউট করার৷ এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ–আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া একে আটকানোর আর কোনও রাস্তা আছে কি? সমাজে প্রতিবাদ না থাকলে অত্যাচারী শাসকরা যেমন সংযত হয় না, তেমনই সমাজও জাগে না, মানুষের বিবেক বাঁচে না, নীতি–নৈতিকতা বাঁচে না৷ যুগে যুগে যখনই সমাজ জুড়ে লড়াই হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে, দেখা গেছে, তখনই সমাজে নীতি–নৈতিকতার মান উঁচু হয়েছে, মানুষ সেই আন্দোলন থেকে উন্নত চেতনার রসদ সংগ্রহ করেছে৷ সমাজ এগিয়েছে৷ স্বাধীনতা আন্দোলনেও বহু বিপ্লবী তাঁদের শিক্ষকদের দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন৷

আসলে মুখ্যমন্ত্রী এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ক্ষমতায় আসীন, যে ব্যবস্থা আজ আর সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে না৷ বরং জনস্বার্থকে পদদলিত করে, প্রতিবাদ–আন্দোলনকে দমন করে৷ শাসকরা জনস্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকেই নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করে৷ সেই কর্তব্যবোধ থেকেই তারা চায় না, জনগণ শোষণ–ত্যাচারের বিরুদ্ধে, তাদের ন্যায্য দাবিতে প্রতিবাদ করুক, আন্দোলন করুক৷ আন্দোলন করলে তাই তাঁরা তাকে নির্মম ভাবে দমন করেন৷ কিন্তু সমাজে যতদিন অন্যায়–বৈষম্য থাকবে ততদিন প্রতিবাদ হবে, আন্দোলন হবে৷ মুখ্যমন্ত্রী কেন, কোনও শাসকই তা আটকাতে পারবে না৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৫ সংখ্যা)