স্কুল শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন বন্ধের জন্য সরকারি তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে৷ যদিও ব্যাপারটা নতুন নয়, বিগত সিপিএম সরকারের আমলে ২০০৫ সালে কলকাতা গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে একই প্রচেষ্টা হয়েছিল৷ প্রশ্ন হল, ছাত্র–ছাত্রীদের আলাদা ভাবে প্রাইভেট টিউশনের প্রয়োজন হবে কেন?
বর্তমানে বিরাট সংখ্যক মহিলা শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত৷ সংসারের বিভিন্ন কাজে অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকতে হওয়ায় তাঁদের বেশিরভাগই প্রায় প্রাইভেট টিউশন করেন না৷ এসএসসির মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দূর–দূরান্তে নিয়োজিত হওয়ায় শিক্ষক–শিক্ষিকারা প্রাইভেট টিউশনের সময়ই পান না৷ আবার সরকারি নিয়মের কারণে এবং স্বেচ্ছায় বহু শিক্ষক এমনিতেই টিউশন করেন না৷ খোঁজ নিলে দেখা যাবে প্রাইভেট টিউশনের সঙ্গে যুক্ত এমন শিক্ষক–শিক্ষিকার সংখ্যা ১০ শতাংশেরও অনেক কম৷ অধিকাংশ শিক্ষক যত্ন নিয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ান, কিন্তু প্রাইভেট টিউশন করেন না৷ বেশিরভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষিত বেকারদের কাছে টিউশন পড়ে থাকে৷ এ কথা সত্য ব্যক্তিগত বা কোচিং সেন্টারে টিউশন পড়া এখন প্রায় সাধারণ বিষয়৷ এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা সরকার কেন বলছে না, যেখানে শিক্ষার্থীদের সমস্ত চাহিদা বিদ্যালয়েই পূরণ হয়ে যাবে, আলাদা করে প্রাইভেট টিউশনের দরকারই পড়বে না৷
স্কুলে পড়ার পরেও অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের জন্য পৃথক প্রাইভেট টিউশনের ব্যবস্থা করেন কেন? শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনের জন্যই কি এর প্রচলন? নাকি করুণ এক বাস্তব দিক থেকেই এর এত রমরমা৷ কয়েক বছর আগে এই পশ্চিমবঙ্গেই চার–পাঁচ হাজার শূন্য পদের জন্য প্রায় ২৭ লক্ষ বেকার আবেদন করেছিলেন৷ উত্তরপ্রদেশে ৬২টি পিওন পোস্টের জন্য আবেদন করেছিলেন প্রায় ৯৩ হাজার শিক্ষিত বেকার৷ তার মধ্যে ৫০ হাজার স্নাতক, ২৮ হাজার স্নাতকোত্তর, ৩৭০০ পিএইচডি ডিগ্রিধারী৷ এ ছাডা বহু এমবিএ, বিটেক ডিগ্রিধারীও ছিল আবেদনকারীদের মধ্যে৷ দেশের প্রতিটি রাজ্যেই কমবেশি একই চিত্র৷ যে দেশে বা রাজ্যে চাকরির অবস্থা এমনই অনিশ্চিত, সেখানে অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হবেন তার উল্লেখ বাহুল্য মাত্র৷ তাঁরা এই প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে নিজের সন্তানকে সেরা জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷
শিক্ষার অধিকার আইনে ৩০: ১ অনুপাতে শিক্ষক নিয়োগ করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা কি রয়েছে? পাঁচটি ক্লাস থাকলেও অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা দুই কিংবা তিন৷ নেই ক্লার্ক বা পিওন৷ তার উপর জনগণনা, ভোটার লিস্টের নাম তোলা ও সংশোধন, মিড ডে মিলের তদারকি সহ শিক্ষাবহির্ভূত নানা কাজের বোঝা পডানোর কাজটিকে গৌণ করে দিয়েছে৷ একইভাবে মাধ্যমিক–উচ্চমাধ্যমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সারা বছর জুডে কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, মাইনরিটি গ্রান্ট, ব্যাগ, সাইকেল, মিড ডে মিল বিতরণ সহ বহু ধরনের কাজ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথচ এর জন্য নেই আলাদা কোনও কর্মী৷ এতে শিক্ষকদের পড়ানোর কাজ ব্যাহত হয়৷
বহু বিদ্যালয়কে জুনিয়র থেকে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ করা হয়েছে৷ অথচ পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি৷ উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগের জন্য ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা নেই বহু স্কুলে৷ এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা তাদের ঘাটতি মেটানোর জন্য যোগ্য প্রাইভেট টিউটরের কাছে তো যাবেই৷ প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষক অবসর গ্রহণ করছেন কিন্তু সে অনুযায়ী নিয়োগ হচ্ছে না৷ ফলে স্কুলে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে৷ এ থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই কি শিক্ষকদের কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে?
এমন একটা শিক্ষার পরিকাঠামো এবং সার্বিক ব্যবস্থা সরকারি উদ্যোগে গডে তোলা দরকার, যেখানে শিক্ষার্থীরা স্রোতের মতো প্রাইভেট টিউশনের জন্য দৌড়বে না৷ সে তার সমস্ত চাহিদা শিক্ষাকেন্দ্রেই পাবে৷ সরকার এই দিকটাতে মনোযোগী হতে আগ্রহী কি?
কিংকর অধিকারী
বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
(৭১ বর্ষ ১২ সংখ্যা ২ – ৮ নভেম্বর, ২০১৮)