শাস্তি দেবে কি, দুষ্কৃতীদের বাঁচাতেই ব্যস্ত বিজেপি সরকার

 

হরিয়ানার ভিওয়ানিতে ১ অক্টোবর বিক্ষোভ

একটা দোমড়ানো, মোচড়ানো দলাপাকানো দেহেরও কত শক্তি। তাকেই এত ভয় বিজেপি সরকারের পুলিশ বাহিনীর! রাতের অন্ধকারে চোরের মতো তারা পুড়িয়ে দিল তাকে! যে আগুন দেখে সাংবাদিকের প্রশ্নটিই আজ মানুষের বিবেকের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে– ‘কী জ্বলছে’? উত্তরটাও জানা, সেই আগুনে বিজেপি সরকারের পুলিশ ছাই করে দিতে চেয়েছে ভারত নামক রাষ্ট্রের গণতন্তে্রর মুখোশটাকেও। যদিও একই সাথে ওই আগুন প্রজ্জ্বলিত করেছে অসংখ্য মানুষের বিবেকের আলো। নির্ভয়া, আসিফা সহ হাজারো অত্যাচারিতা নারীর উপর ক্রমাগত ঘটে চলা অত্যাচার, সরকারের নিষ্ঠুর অবহেলা আর বিচারহীনতার অবসান চেয়ে রাস্তায় নেমেছেন তাঁরা।

মায়ের সাথে বাজরার খেতে কাজ করতে গিয়েছিল উত্তরপ্রদেশের হাথরসের ফুটফুটে কিশোরী মনীষা বাল্মিকী। নরপশুর দল ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মম অত্যাচার চালায় তার উপর। যাতে চিৎকার করতে না পারে সে জন্য জিভ কেটে নেয়, নৃশংসভাবে মেরে ঘাড়, হাত, পা, কোমর ভেঙে দেয়। ১৫টা দিন অসহ্য যন্ত্রণার পর মেয়েটির মৃত্যু হয়। যে সরকার তার চিকিৎসার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার দরকার মনে করেনি, তারাই তৎপর হয়ে উঠল সবার চোখের আড়ালে তাকে ডিজেল ঢেলে পুড়িয়ে দিতে।

দেশের মানুষের চোখ থেকে সবকিছু আড়াল করতে নির্যাতিতার গ্রামকে দুর্গ বানিয়ে ফেলে বিজেপি সরকারের পুলিশ। জেলাশাসক নিজে গিয়ে নির্যাতিতার বাবা সহ পরিবারকে হুমকি দেন, বয়ান বদল করো, না হলে ভুগতে হবে। সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ নিষেধ হয়ে থাকল কয়েক দিন। তবু রাজধানী দিল্লি সহ সর্বত্র আছড়ে পড়ল প্রতিবাদের ঢেউ। পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে দিল্লিতে মহিলা প্রতিবাদীদের উপর। বাল্মিকী সম্প্রদায়ের বিক্ষোভে আগরায় লাঠি চালিয়েছে পুলিশ। সারা দেশ জুড়ে জ্বলে ওঠা প্রতিবাদের আগুনের তেজ থেকে নিজেকে আড়াল করতে মুখ্যমন্ত্রী সিবিআই তদন্তের ঘোষণা করেছেন।

অথচ তাঁর পুলিশ বলে দিয়েছে, কোনও ধর্ষণই হয়নি। ফরেনসিক রিপোর্টে নাকি ধর্ষণের চিহ্ন মেলেনি, পুলিশের বক্তব্যই হয়ে গেল অকাট্য প্রমাণ! আর যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ওই কিশোরী নিজের মুখে ডাক্তার এবং পুলিশের কাছে যে অত্যাচারের কথা বলে গেল, সেগুলি সব মিথ্যা? তার চরম অত্যাচারিত দেহটাও কি অত্যাচারের নিশ্চিত প্রমাণ নয়?

উত্তরপ্রদেশ পুলিশের কাছে নির্যাতিতাকে রক্ষা করা, তার উপর অত্যাচারের বিচার করার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি সরকারের মুখ রক্ষা করা। তাই নির্যাতিতার বাড়ি থেকে সামান্য দূরেই শাসক দলেরপ্রাক্তন বিধায়কের বাড়িতে কয়েকশো লোক নিয়ে পুলিশি পাহারায় অভিযুক্তদের পক্ষে সভা করতে পেরেছে তথাকথিত উচ্চবর্ণের বিজেপি সমর্থকরা। সরকার করতে দিল কেন? কারণ, এই উচ্চবর্ণের ভোটব্যাঙ্কই বিজেপির প্রধান সম্বল। বিজেপির আর এক বিধায়ক উপদেশ দিয়েছেন, মেয়েদের শিক্ষা দিলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে। অর্থাৎ ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাই দায়ী। তিনি আরও বলেছেন, পরিবারকেই দায়িত্ব নিতে হবে যাতে তাদের মেয়েটি ধর্ষিতা না হয়। অপূর্ব উপদেশ সন্দেহ নেই! ঠিক এমনটাই তো লেখা আছে সংঘ পরিবারের নীতি শাস্ত্রে! ঠিক এই কথাই তো নির্ভয়ার ঘটনা নিয়ে বলেছিলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত, ধর্ষণে অভিযুক্ত আরএসএস ঘনিষ্ঠ গডম্যান আশারাম বাপু। শুধু তাঁরা কেন, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ২০১৭ সালে বলেছেন, মেয়েদের স্বাধীনতা থাকা উচিত নয়। এমনকি তাঁর উপস্থিতিতে ‘বিরাট চেতনা rally’তে যখন বলা হয়েছে, মুসলিম মহিলাদের কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করতে হবে, আদিত্যনাথজি প্রতিবাদ করেননি (দ্য ক্যুইন্ট ২১.০৩.২০১৭ এবং ফ্যাক্ট চেক ২৯.০৯.২০২০)। এঁরা রুখবেন নারী নির্যাতন!

এত কিছু ঘটে গেল, অথচ প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু বলবার প্রয়োজন মনে করলেন না! শোকার্ত পিতা-মাতাকে সন্তানের দেহটাকে শেষবারের মতো দেখতে দিলে পুলিশের তদন্তের কী অসুবিধা হত? নির্যাতিতার ভাই, বাবা সহ পরিবারের সকলকে, গ্রামের দলিত জনগণকে হুমকি দিয়ে কোন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করেছে পুলিশ? নির্যাতিতার ভাই লুকিয়ে সংবাদকর্মীদের বলেছেন, তাঁরা প্রাণনাশের আশঙ্কা করছেন। এই আশঙ্কা দূর করতে কী করেছে বিজেপি সরকার?

চাপে পড়ে সরকার যখন ক্ষতিপূরণের টাকা, বাড়ি, চাকরির ঘোষণা করছে, সেই সময় সরকারি আধিকারিক নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়ে বলে আসছেন, ‘মেয়ে করোনায় মরলে এত কিছু পেতে?’ এই খবর বাইরে আসতে শিউরে উঠেছে সারা দেশ, এত নির্মম হতে পারে কোনও প্রশাসন? কত নিচ পর্যায়ের এবং ক্রিমিনাল মানসিকতার হলে কেউ মৃত্যু নিয়েই এভাবে কথা বলতে পারে! সরকার এ কথার প্রতিবাদ করল না কেন? বরং উল্টো পথে হেঁটে শুধু উত্তরপ্রদেশ সরকার নয়, কেন্দে্রর মোদী সরকারের শীর্ষ স্তর থেকেও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে ‘সতর্ক’ করা হয়েছে। সরকার বিরোধী যে কোনও সংবাদই তাদের ভাষায় ‘ফেক নিউজ’। বলে দেওয়া হচ্ছে হাথরসের ঘটনা নিয়ে যেন বেশি ‘বাড়াবাড়ি’ না করা হয়।

বেটি বাঁচাও স্লোগান দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর আমলে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য– দেশে প্রতি ১৬ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিতা হন, প্রতি ৬ মিনিটে যৌন হেনস্থার শিকার কোনও না কোনও নারী। আর তাঁর অনুগামী মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরপ্রদেশ মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের নিরিখে আছে প্রথম স্থানে। দলিত মহিলাদের উপর অত্যাচারেও প্রথম উত্তরপ্রদেশ। ওই হাথরসের ঘটনা নিয়ে হইচইয়ের সময়েই অতি নিকটের গ্রাম বলরামপুরে ধর্ষিতা হয়ে প্রাণ দিয়েছেন আর এক মহিলা। আরও বেশ কয়েটি ঘটনা একই সময় দেশের নানা জায়গায় ঘটেছে।

কে বাঁচাবে বেটি? মানুষ দেখেছে, শাসক দল বিজেপির নেতারা জম্মুতে ধর্ষকদের নিয়ে বিজয়মিছিলে পা মিলিয়েছেন। বিজেপির উচ্চবর্ণের হিন্দুত্বঘেঁষা রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে মুসলিম এবং দলিত বিরোধী জিগিরের উপর। মহিলাদের প্রশ্নেও তাদের অবস্থান চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল। দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি যে, তথাকথিত বিজেপি বিরোধী কংগ্রেসের মতো দক্ষিণপন্থী দলগুলির নেতাদের ক্ষেত্রেও সূক্ষ্মভাবে কাজ করে যায় হিন্দুত্ববাদী মানসিকতা। যেখানে বাইরে যতই আধুনিকতা থাকুক অন্তরে মহিলাদের সম্বন্ধে ধারণাটা ধর্মীয় কাঠামোতেই বাঁধা। যেখানে পুরুষই শ্রেষ্ঠ। দলিত রাজনীতির প্রবক্তা দক্ষিণপন্থী দলগুলির ক্ষেত্রেও চিন্তায় রয়েছে একদিকে ধর্মীয় চিন্তারই কাঠামো, যেখানে নারী পুরুষের অধীন। অন্যদিকে জাতপাতকে কাজে লাগিয়ে দলিত নেতাদের আখের গোছানোর চেষ্টা, যেখানে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের প্রকৃত বিকাশের কোনও লক্ষ্য নেই। তাই মনীষার সুবিচারের আশায় দেশের মানুষের যে আকুতি, ধর্ষণ-নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের যে লড়াই তার সাথে নিছক ভোটের জন্য কিছু দাপাদাপিকে মিলিয়ে ফেললে চলবে না। দুষ্কৃতীদের প্রশ্রয় দেওয়ার অপচেষ্টা বন্ধ করার জন্য শাসকদল এবং সরকারকে বাধ্য করতে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে, মদ ও নেশার প্রসার রুখতে চাই শক্তিশালী গণতান্ত্রিক আন্দোলন।

বিচার পায়নি মনীষা, বিচার পায়নি আসিফা, বিচার পায়নি নির্ভয়া, বিচার পায়নি উন্নাওয়ের নির্যাতিতা। এই সমাজ ব্যবস্থায় এইভাবে কত শত মনীষার মা-বাবা চোখের জলে বিচারের দাবি জানায়। কিন্তু বিচার মেলে না। নির্যাতিতার মায়ের চোখের জলে করুণ আর্তির প্রকাশ ঘটেছে– ‘সরকার বদল হয়, কিন্তু অবস্থার বদল হয় না।’ এই সত্যটাই আজ বুঝতে হবে। অবস্থাটার বদল হয় না ততক্ষণ যতক্ষণ সমাজব্যবস্থার বদল না হয়। ফলে নারীদের উপর অত্যাচার আরও বাড়তেই থাকবে। কারণ, মূল্যবোধ-নীতি বিবর্জিত সবদিক থেকে দেউলিয়া এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হাজারো নরপশুদের জন্ম দেয়। তাদের লালসার শিকার হতে হয় শত শত মহিলাকে। আর নিজেদের স্বার্থপূরণে, নানা রকম অসামাজিক, অনৈতিক কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য এই নরপশুদের সমর্থন জোগায় শাসক দলগুলি। এটাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে শোষিত নির্যাতিত মানুষ তাদের বিচার পাবে না ততক্ষণ, যতক্ষণ না সমস্ত মানুষ এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই গড়ে তুলবে। যে সমাজ এই নরপশুদের জন্ম দেয় সেই সমাজকে বদলানোর লড়াই গড়ে তোলা ছাড়া বিচার অধরাই থেকে যাবে। একের পর এক কন্যার চিতার আগুন বুকে যে জ্বালা ধরিয়েছে তা থেকেই জন্ম দিতে হবে প্রতিবাদের বহ্নিশিখাকে।

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ৮ সংখ্যা_৫ অক্টোবর, ২০২০)