শাসকের শত চেষ্টাতেও ধ্বংস হয়নি মানবতা

দেশে আজ চারিদিকে আর্তনাদ— অক্সিজেন নেই,  হাসপাতালে বেড নেই, অ্যাম্বুলেন্স নেই, চিকিৎসার সুযোগ মিলছে না। মৃত্যু মিছিলে শ্মশান কবরস্থানগুলি ভরে যাচ্ছে। পোড়ানোর কাঠ নেই, কবর দেওয়ার স্থান সংকুলান হচ্ছে না। শয়ে শয়ে মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে গঙ্গায়। শকুন, কাক, কুকুরে টেনে খাচ্ছে। এই গভীর অন্ধকারে শাসকরা যখন হাত গুটিয়েছে, আশার আলো দেখাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

এমনই আলোর সাক্ষী হল এই পশ্চিমবঙ্গেরই হুগলির দাদপুর। করোনা আবহে বাবার মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যেতে যখন নিজের আত্মীয় স্বজনদের পাশে পাচ্ছিলেন না মৃত হরেন্দ্রনাথ সাধুখাঁর ছেলে চন্দন। তখন এগিয়ে এসেছেন গোলাম সুব্বানি, আশিকেরা। দিনটা ছিল খুশির ইদের। কিন্তু প্রতিবেশীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আনন্দে মাতার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন এলাকার মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ। তারাই করেছেন হরেন্দ্রনাথের দাহকাজ। প্রচার চাননি তারা। বলেছেন, এটাই তো মানুষের কাজ,  এটাই তো মানুষের ধর্ম— একের বিপদে অন্যের পাশে দাঁড়ানো। ঠিক এমন করেই মনুষ্যত্ব বেঁচে আছে ওই জালাল মোল্লাদের মধ্যে। উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালের মৃতদেহ শ্মশানে কবরে পৌঁছে দিয়ে সৎকারের কাজে সাহায্য করে চলেছেন যিনি। ব্রিটিশদের মতোই স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের শাসকরাও কম চেষ্টা করেনি মেহনতি মানুষের ঐক্য ভাঙতে,  সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার করে মানুষে মানুষে বিভেদ বাড়াতে। কিন্তু মানুষের প্রথম পরিচয় তার মানবধর্ম,  সে ধর্ম যে এত সহজে ধ্বংস হয় না,  সেই পরিচয় পাওয়া শুধু এই দুটি ঘটনায় নয়,  পাওয়া যায় দেশজুড়েই। যেমন, কাশ্মিরী পণ্ডিত মাখনলাল দীর্ঘদিন শ্রীনগরের বাসিন্দা। তাঁর মৃত্যুতে ধর্মে মুসলিম প্রতিবেশীরা অন্ত্যেষ্টির সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। একই ছবি দেখা গেছে অন্ধ্রপ্রদেশেও। আবার এ রাজ্যে রমজানের উপবাসের মধ্যেও ঝাড়গ্রামে গোপাল রাউত,  অমর পালদের সাথে কবীর মুন্সী,  শেখ নাসিরউদ্দিনদের দেখা যায় একসাথে বাড়ি বাড়ি ওষুধ,  খাবার পৌঁছে দিতে। এ চিত্র গোটা দেশে ছড়িয়ে আছে।

এ গেল সাধারণ মানুষের কথা। কিন্তু হিন্দুত্বের স্বঘোষিত ঠিকাদার বিজেপি আরএএস এর ক্ষেত্রেও কি সত্যটা একই? না। তারা যে এমন মানবতার ধার ধারেন না, ধর্মের পরিবর্তে তাদের হাতিয়ার যে শুধুই সাম্প্রদায়িকতা তার প্রমাণ তারা দিয়ে চলেছেন। ধর্মীয় পরিচয় তুলে, বিদ্বেষের রাজনীতি করছেন তারা এই সংক্রমণের দুঃসময়েও। গুজরাটের ভদোদরা তার সাক্ষী। দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে শ্মশানের কাঠ সরবরাহ করছিলেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের যুবকরা। কিন্তু বাধা দিয়েছেন শাসক বিজেপির নেতারা। গুজরাটের ভদোদরায় বিজেপি সভাপতি বিজয় শাহ আপত্তি তুলে বলেছেন হিন্দু ধর্মের সত্ত্বার সম্পর্কে মুসলিমদের কী জ্ঞান আছে, তাই ওদের শ্মশানে ঢুকতে দেওয়া যাবে না (ইন্ডিয়া টাইমস,১৯ এপ্রিল,২০২১)। সর্বত্রই সাধারণ মানুষের বিপরীতে দাঁড়াচ্ছে বিজেপি-আরএসএসের ভূমিকা। মনে  পড়ে যায় কবিতার সেই লাইনগুলো… ‘আমার ঘরের বাঁয়ে থাকেন রাখহরি, ডানদিকের পড়শি আমার আল্লারাখা। কেউ বলতো একই বৃন্তে দুটি কুসুম,  কেউ বলতা একই গাছের দুটি শাখা….।

এই হল সাধারণ মানুষের কথা। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে  এই দেশ অতীতেও বহু বিপর্যয়ে ও বিপন্নতায় এমন সম্প্রীতি সৌহার্দ্যের সাক্ষী থেকেছে।

মানুষের কামনা,  দেশের শাসকরা যতই মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢেলে দিতে চাক,  বিভেদের বেড়ায় আটকাতে চাক সেখানেই যেন রুখে দাঁড়াতে পারে মানবতা। শাসকের ফ্যাসিবাদী সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের রাজনীতি রুখতে এমন করেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলুক আশিক, চন্দন, গোলামরা। এ চলা আটাকায় এমন সাধ্য কোন শাসকের?

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা