Breaking News

শারদীয় বুকস্টল, উন্মাদনার স্রোতে যেন এক লাইটহাউস

শিয়ালদহ স্টেশন

আলো ঝলমল শহর–মফস্বঃল৷ রাস্তায় জনস্রোত৷ মানুষ গা ভাসিয়েছে শারদোৎসবে৷ সুসজ্জিত নারী–পুরুষের ভিড় দুর্গাপূজার প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে৷ জীবনের হাজারো সমস্যা পাশে সরিয়ে রেখে উৎসবের উন্মাদনায় ছুটে চলেছে মানুষ৷ এই স্রোতের মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে লাল কাপড়ে মোড়া বইয়ের স্টলগুলি৷ গণআন্দোলনের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবিতে সাজানো স্টলের মাঝখানে সর্বহারার মহান নেতা এস ইউ সি আই (সি)–র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের উজ্জ্বল ছবি৷ লাল শালু ঢাকা কাঠের টেবিলে সারি সারি সজ্জিত দলের নানা প্রকাশনা৷ বইপত্র হাতে দলের স্বেচ্ছাসেবকরা চলমান মানুষের কাছে তুলে ধরছেন এস ইউ সি আই (সি)–র মূল্যবান বইগুলি৷

প্রতি বছরের এই পরিচিত ছবি দেখা গেছে এবারেও৷ শুধু কলকাতা নয়, রাজ্য জুড়েই দলের কর্মীরা পথে পথে পা–মেলানো অগণন মানুষের কাছে দলের বক্তব্য পৌঁছে দিতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন কিংবা বাজার–গঞ্জ এলাকায় অসংখ্য স্টল সাজান শারদোৎসবের দিনগুলিতে৷ এমনকী রাজ্যের বাইরেও, যেখানেই শারদোৎসব উপলক্ষে মানুষের সমাগম হয়, সেখানেই দলের প্রকাশনা নিয়ে উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকরা৷

দলের অন্যতম সংগ্রামী কর্মসূচি এই বুকস্টল৷ শারদোৎসবের দিনগুলিতে কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুটের মতলবে বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থা যখন উচ্চকিত বিজ্ঞাপনের উজ্জ্বলতার ফাঁদে ফেলে মানুষকে ভোগের নেশায় মাতিয়ে তুলতে চায়, সমস্যা–জর্জরিত বিভ্রান্ত মানুষকে যখন উল্লাসের উন্মাদনায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় তখন এইসব বুকস্টল যেন দু–দণ্ড দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থাটা তাদের একটু ভেবে দেখতে বলে৷ রোশনাইয়ের ঠিক তলায় জমে থাকা অন্ধকারে যে মানুষগুলি পরিজনের মুখে খিদের অন্নটুকু তুলে দিতেই জেরবার হয়ে যাচ্ছে, নতুন পোশাক দূরে থাক, গায়ে যাদের আস্ত একটা জামাও নেই, মনে করিয়ে দিতে চায় সেই মানুষগুলির কথা৷ স্রোত এখানে যেন একটু থমকায়৷ মানুষ দাঁড়ায়, বই নেয়, আলোচনা করে৷ কেন এমন বীভৎস দারিদ্র, কেন ফুটপাথই ঘরবাড়ি এত মানুষের, এমন ভয়ঙ্কর বেকারির কারণ কী, মূল্যবোধের এই সংকট কার দোষে সমাজকে ছেয়ে ফেলছে, সরকারি গদিতে একের পর এক চড়ে বসা ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলির চরম ঠগবাজি থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় কী, এই অসহনীয় জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে কোন পথে– এ সব প্রশ্ন আজ ধাক্কা দিচ্ছে অনেককেই৷ উত্তর খুঁজতে তাঁরা ভিড় করেছেন বুকস্টলে৷ এঁদের মধ্যে যেমন আছেন ছাত্র–যুবক–মহিলা–চাকরিজীবী-ব্যবসায়ী, তেমনই আছেন নানা বামপন্থী দল সহ অন্য রাজনৈতিক দলের নিচের তলার কর্মী–সমর্থক৷ মার্কসবাদী নামধারী দলগুলির চরম আদর্শহীনতা, ভোটসর্বস্ব সুবিধাবাদী রাজনীতি ভাবিয়ে তুলেছে বহু বামপন্থী মনোভাবাপন্ন মানুষকে৷ একজনও এম এল এ–এম পি না থাকা সত্ত্বেও এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) কোথা থেকে পায় লড়াইয়ের এত শক্তি– সে কথা বুঝে নিতে তাঁরা বেছে বেছে সংগ্রহ করে নিয়ে গেছেন দল প্রকাশিত নানা রাজনৈতিক পুস্তিকা৷ তাঁরা বুঝতে চান এদেশের মাটিতে কোন পদ্ধতিতে একটি সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে দিয়ে গেছেন এ যুগের অন্যতম মার্কসবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষ৷ দেশ জুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে যে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ও তার স্যাঙাৎরা, এদেশে তাদের বাড়বাড়ন্ত হওয়ার জন্য কারা দায়ী, কীভাবেই বা রোখা যাবে সমাজকে পিছনের দিকে টেনে নামাতে চাওয়া এই অপশক্তিকে, সে সম্পর্কে মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষ চিন্তাধারার ভিত্তিতে যে দিশা দেখিয়ে চলেছে এস ইউ সি আই (সি), তাও জানতে বুঝতে চেয়েছেন তাঁরা৷

শিলিগুড়ি

বুকস্টলে এসেছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ৷ এসেছেন মহিলারা, যাঁরা নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়েও সমাজে–সংসারে মানুষের মর্যাদা পান না৷ আগ্রহের সঙ্গে সংগ্রহ করেছেন নারীমুক্তি সংক্রান্ত কমরেড শিবদাস ঘোষের রচনা ও অন্য লেখাপত্র৷ অভিভাবকরা সাগ্রহে নিয়ে গেছেন কমরেড প্রভাস ঘোষের ‘কিশোরদের প্রতি’ পুস্তিকা– পড়তে দেবেন ঘরের ছেলেমেয়েদের৷ গোটা সমাজ জুড়ে নীতি–নৈতিকতার ধস যে ভাবিয়ে তুলেছে তরুণ প্রজন্মকে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বুকস্টলে৷ বহু তরুণ–তরুণী বুকস্টলে এসেছেন, আগ্রহ নিয়ে বই খুঁজেছেন, সংগ্রহ করেছেন ‘মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতার কেন এই অধঃপতন’ পুস্তিকা সহ নানা বইপত্র৷ মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে শরৎচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, নেতাজি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল সহ মনীষীদের মূল্যায়ন এবং আজকের দিনে তাঁদের জীবনসংগ্রাম ও শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা সংক্রান্ত নানা বই ব্যাপক হারে সংগ্রহ করেছেন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ৷ গভীর আগ্রহে পড়তে চেয়েছেন শিবদাস ঘোষের ‘নির্বাচনসর্বস্ব রাজনীতি নয় বিপ্লবী আন্দোলনই মুক্তির পথ’ বইটি৷

সংকটের যে কালো মেঘ আজ সমাজের সমস্ত দিক ছেয়ে ফেলতে চাইছে, এস ইউ সি আই (সি)–র বুকস্টলগুলি তার মধ্যে যেন সূর্যালোকের রূপালি রেখা৷ অন্যায় শোষণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই রাষ্ট্রব্যবস্থা গুটিকয়েক ধনকুবেরের মুনাফা লুটের রাস্তা মসৃণ রাখতে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষকে জ্ঞানচর্চা, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা থেকে সরিয়ে রাখার হাজারো অপচেষ্টা চালাচ্ছে৷ কিন্তু বিজ্ঞান বলে সেটাই শেষ কথা নয়৷ নিপীড়িত মানুষ এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তির পথ খুঁজবেই৷ শারদীয় বুকস্টলে মানুষের আগ্রহ সেই সত্যকেই দেখিয়ে গেল৷

(৭১ বর্ষ ১২ সংখ্যা ২ – ৮ নভেম্বর, ২০১৮)