এ দেশের কৃষক আন্দোলন নতুন মাত্রা নিতে চলেছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের ১৭টি রাজ্যের রাজধানী শহরে এআইকেকেএমএস-এর নেতৃত্বে কৃষক সমাবেশগুলি সে কথাই জানিয়ে দিল। ওই দিন কলকাতার শহিদ মিনারের সমাবেশে বিশাল কৃষক জমায়েতের সামনে সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর ঘোষ জানালেন, কেন্দে্রর সরকার ‘ন্যাশনাল পলিসি ফ্রেম ওয়ার্ক অন এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং’ নামে একটা খসড়া নীতি চালু করতে চাইছে। এই নীতিতে অনেক ভাল ভাল কথার আড়ালে দেশের কৃষক-খেতমজুর সহ সাধারণ জনগণের উপর ভয়ানক এক আক্রমণ নামিয়ে আনতে চলেছে। এতে এমএসপি নিয়ে কোনও কথা নেই। সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি চাষের উপকরণ চাষিরা কী ভাবে সস্তায় পাবে তার কোনও উল্লেখ নেই। এতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, সমগ্র কৃষি বিপণন ব্যবস্থাকে বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দেওয়া হবে। বাস্তবে ৭০৫৭টি সরকারি মান্ডি বহুজাতিক কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হবে। ছোট বড় ২৯ হাজারের বেশি হাট কর্পোরেট মালিকদের দেওয়া হবে। যে চুক্তিচাষ কৃষককে বৃহৎ পুঁজিপতিদের শোষণের সামনে ঠেলে দেবে, সেই চুক্তিচাষকে কার্যকর করার কথা এতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনতে পারবে। এর ফলে চাল ডাল রাই ফল ডিম মাছ দুধ সহ সমস্ত খাদ্যদ্রব্য বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কোম্পানি-নির্ধারিত দামে সকলকে কিনতে হবে।
এ এক ভয়ঙ্কর আক্রমণ। কৃষকরা এটা মানবেন না। তাঁরা প্রতিরোধ করতে বদ্ধপরিকর। তাঁদের দৃপ্ত ঘোষণা– দিল্লি বর্ডারে ৭৩৬ জন কৃষকের প্রাণদান তাঁরা ব্যর্থ হতে দেবেন না। ২০২০ সালে দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিলেন, ওরা জানে না রাস্তায় বসে আইন পাল্টানো যায় না। কৃষকরা এর যোগ্য জবাব দিয়েছেন। দীর্ঘ ১৩ মাস শীত গ্রীষ্ম বর্ষা মাথায় নিয়ে এই ঐতিহাসিক আন্দোলন সরকারকে কালা কৃষি আইন বাতিল ঘোষণা করতে বাধ্য করেছে। এবার সরকার পুঁজিপতিদের স্বার্থে তৈরি ওই কৃষিনীতি ঘুরপথে কৃষক স্বার্থের মধুমাখা বুলির আড়ালে কার্যকর করার ষড়যন্ত্র করছে। তাই এই লড়াইকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে কৃষকরা। তারই প্রাথমিক ধাপ ছিল রাজ্যে রাজ্যে রাজধানী শহরে এই কৃষক সমাবেশ, যার আয়োজন করেছিল এ আই কে কে এম এস।
কেন্দে্রর কৃষিনীতির বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় স্তরে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে সংযুক্ত কিসান মোর্চা। ৫০০টি কৃষক সংগঠন এর সঙ্গে যুক্ত, যার অন্যতম এআইকেকেএমএস। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ। এ দিনের সমাবেশে প্রধান বক্তা কমরেড শঙ্কর ঘোষ এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন, ১৯৪৬-৪৭ সাল নাগাদ এই পশ্চিমবঙ্গে কৃষকরা ঐতিহাসিকতেভাগা আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কৃষকদের দাবি ছিল, ফসলের তিনভাগের এক ভাগ পাবে জমির মালিক, আর দুই ভাগ পাবে চাষিরা, যারা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে উৎপাদন করে। এই আন্দোলন একটা প্রবল রূপ নিচ্ছিল। একটা পর্বে এসে অবিভক্ত সিপিআই (যার মধ্যে তখন সিপিএম এবং সিপিআই-এমএল ছিল) নেতারা কৃষকদের বললেন, তোমরা ঘরে ফিরে যাও। আন্দোলন করা যাবে না। জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তার পাশেই সবাইকে দাঁড়াতে হবে। নেহেরুকে বিব্রত করা যাবে না। আন্দোলনে সিপিআই-এর এই বিশ্বাসঘাতকতা কৃষকদের আহত করেছিল। এই সময় তাঁদের পাশে দাঁড়ালেন বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ। তিনি বললেন, আন্দোলন চলবে। এত বড় কৃষক অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করা যাবে না। কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী, কমরেড শচীন ব্যানার্জী ও কমরেড নীহার মুখার্জীকে নিয়ে তিনি দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে সংগঠিত করতে লাগলেন। কমরেড প্রীতীশ চন্দ, কমরেড তাপস দত্ত প্রমুখ নেতাদের পাঠালেন। তাঁরই পরিচালনায় মৈপীঠে গেলেন কমরেড বীরেন ব্যানার্জী, বেলেদুর্গা নগরে গেলেন কমরেড রেণুপদ হালদার, কমরেড অমর ব্যানার্জী। নিমপীঠ ফুটিগোদায় কমরেড ইয়াকুব পৈলান, বাইশহাটা মণিরতটে কমরেড সুধীর ব্যানার্জী, জটা-ভুবনেশ্বরীতে কমরেড কৃষ্ণ গাঁতাইত, গিলের ছাঁটে কমরেড পাঁচু কাঁসারী চাষিদের সংগঠিত করলেন। ১৯৫০ সাল নাগাদ আন্দোলন আবার তীব্রতর হল। এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতাতেই গঠিত হল এআইকেকেএমএফ, যার নাম পরবর্তীতে হয়েছে এআইকেকেএমএস। তারপর থেকে এআইকেকেএমএস বহু আন্দোলন সংগঠিত করেছে। এ দিনের সমাবেশে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের সমালোচনা করে কমরেড শঙ্কর ঘোষ বলেন, এই সরকারও কেন্দ্রীয় কৃষি বিলের বিরুদ্ধে নীরব। রাজ্য সরকারের কাছে আমরা দাবি করেছিলাম, আপনারা চাষির কাছ থেকে পাট কিনে চটকলগুলিতে বিক্রি করুন। আজও এই দাবি তারা মানল না। এই দাবি মানলে পাট চাষের সাথে যুক্ত পরিবারগুলোর এক কোটি মানুষ বাঁচত। সংগঠন দাবি করেছিল, চাষির কাছ থেকে ন্যায্য দামে আলু কিনুক সরকার, উত্তরবঙ্গে ক্ষুদ্র চা চাষিদের কাছ থেকে চা কিনে সরকার বড় কোম্পানিকে বিক্রি করুক। সরকার চাষিদের কোনও দাবি মানছে না। তিনি বলেন, এগুলো নিয়ে আমরা কৃষক কমিটি গড়ে তুলে আন্দোলন গড়ে তুলব। রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আপনারা বিধানসভায়কেন্দ্রীয় কৃষি নীতির বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব নিন। পরিষ্কার করে বলুন– কেন্দ্রীয় কৃষিনীতি আপনারা চালু করবেন না। কংগ্রেসের সমালোচনা করে তিনি বলেন, যে সমস্ত রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় রয়েছে কেন্দে্রর এই কৃষিনীতিতে তারা সাহায্য করছে। তিনি বলেন, আসলে কর্পোরেটের কাছে এদের সকলেরই টিকি বাঁধা।
এ দিনের সমাবেশে এ দেশে কৃষক আন্দোলনের পরম্পরা তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এ দেশে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, মুণ্ডা বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, তেলেঙ্গানা আন্দোলন, সিঙ্গুর আন্দোলন, নন্দীগ্রাম আন্দোলন এবং সর্বশেষে দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন– প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে কৃষক তার ক্ষমতা-দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, আমরা লড়ব, আমরা জিতব। আমরা আমাদের দুঃখের কথা বলার জন্য এই সমাবেশ করিনি। কৃষকের জীবন দুঃখে ভরা, সমস্যায় ভরা। কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের দেখিয়েছেন, এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কৃষক জমি হারিয়ে খেতমজুরে পরিণত হবে, সব হারাবে। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অন্য রকম হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এর বিরুদ্ধে লড়াই করে আমাদের বাঁচতে হবে এবং এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পাল্টাতে হবে। তিনি বলেন, সংযুক্ত কিসান মোর্চার কাছে আমরা প্রস্তাব রেখেছি, দেশে ৬ লক্ষ ৪০ হাজার গ্রামের মধ্যে অন্তত তিন লক্ষ গ্রাম কমিটি আমাদের গঠন করতে হবে। সর্বত্র মহাপঞ্চায়েত করতে হবে। সব কৃষক সংগঠনকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ রাজ্যে কুড়ি হাজার গ্রামের মধ্যে অন্তত চার হাজার গ্রাম কমিটি আমাদের করতে হবে। এ কাজে এআইকেকেএমএস-কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। তিনি বলেন, এ সংগ্রাম এক মহান সংগ্রাম। পুঁজিবাদের শৃঙ্খলে সমাজের অগ্রগতি আটকে আছে। আমাদের সেই অগ্রগতির দরজা খুলে দিতে হবে। এই সংগ্রামে কৃষকদেরও যোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজ্যের আর জি কর আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, সরকারের কাজ খুনিদের খুঁজে বের করা। কিন্তু এখানে সরকার খুনিদের সাহায্য করছে। দিল্লি থেকে সিবিআই এল। রাজ্য পুলিশের রিপোর্টের বাইরে যেতে পারল না সিবিআই। এখানেই ঐক্য– বুর্জোয়া শ্রেণি ঐক্য। দুই সরকারই অপরাধীদের আড়াল করছে। সমাবেশে এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন রাজ্য সম্পাদক কমরেড গোপাল বিশ্বাস। সভাপতিত্ব করেন রাজ্য সভাপতি কমরেড পঞ্চানন প্রধান।
মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। রাজ্যে আন্দোলন সংক্রান্ত পাঁচটিপ্রস্তাব গৃহীত হয়। একক কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে এই সমাবেশ কৃষক আন্দোলনে অবশ্যই গতি সঞ্চার করবে।