কেরালায় সিপিএম সরকারের পদক্ষেপে সাম্প্রদায়িক ও জাতপাতবাদী শক্তিগুলিই মদত পাচ্ছে —কেরালা রাজ্য এস ইউ সি আই (সি)
নবজাগরণের মূল্যবোধের পুনরুত্থানের নামে এবং শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশাধিকারের দাবিতে কেরালার শাসক সিপিএম কিছু জাতপাতবাদী সংগঠনের সাথে হাত মিলিয়ে যে ‘উইমেন্স ওয়াল’ বা ‘মহিলা দেওয়াল’ তৈরির কর্মসূচি নিয়েছে এবং তার জন্য সরকারি টাকা খরচ করে প্রচার চালাচ্ছে, সেই প্রসঙ্গে এসইউসি আই (কমিউনিস্ট)–এর কেরালা রাজ্য সম্পাদক কমরেড ডাঃ ভি ভেনুগোপাল ১ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে বলেন,
‘এর দ্বারা কেরালার নবজাগরণ আন্দোলনকেই কালিমালিপ্ত করা হবে৷ এর একমাত্র লক্ষ্য ভোটে সুবিধালাভ৷
কেরালার নবজাগরণ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবতাবাদী সংস্কৃতির ভিত্তিতে৷ কিন্তু সিপিএম সরকার পরিচালিত এই ‘মহিলা দেওয়াল’ আন্দোলনের বিরুদ্ধ মতবাদের প্রতি কোনও সহনশীলতাই নেই৷ যে সরকার বিরুদ্ধ মতবাদকে হত্যা করতে সংবাদমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাদের নবজাগরণ সম্পর্কে বড় বড় কথা বলার কী অধিকার আছে? একসময় শুধুমাত্র উচ্চ ও নিম্নবর্ণের বিভেদের বিরুদ্ধে নয়, একই বর্ণের অভ্যন্তরীণ বিভেদ সহ নানা কু–ভ্যাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল কিছু সংগঠন৷ পরবর্তীকালে তারা সংশ্লিষ্ট জাতি–গোষ্ঠীর কায়েমি স্বার্থবাদীদের হাতে রাজনৈতিক দলগুলির উপর চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী এবং ভোটব্যাঙ্ক তৈরির সংগঠনে অধঃপতিত হয়৷ ওই সব সংগঠন নবজাগরণ আন্দোলনের মহান নেতাদের তুলে ধরা মূল্যবোধ থেকে শুধু সরে এসেছে তাই নয়, তার বিরুদ্ধেই কাজ করছে৷ এই ধরনের সংগঠন, যাদের কোনও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নেই, লক্ষ্য কেবল শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে জাতপাতবাদী কতিপয় নেতার স্বার্থ চরিতার্থ করা– তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কোন মূল্যবোধের জাগরণ ঘটবে?
‘ঈশ্বরের দৃষ্টিতে যা ঠিক তাই সঠিক, যা নয় তা ভুল’– এই মতবাদ সামন্ততন্ত্রের আদর্শগত ভিত্তি৷ বিপরীতে নবজাগরণ তুলে ধরেছে সবকিছুকে যুক্তির ভিত্তিতে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সত্যে উপনীত হওয়ার জীবনদর্শন৷ কেরালায় নারায়ণগুরুর বিখ্যাত ঘোষণা ছিল, আমাদের কোনও ধর্ম বা জাত নেই৷ এর মধ্য দিয়ে কেরালায় নবজাগরণ আন্দোলনের শুরু৷ পরে এই আন্দোলনের অগ্রগতিতে চিন্তা আসে, ‘মানুষের কোনও ধর্ম, জাত বা ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই৷’ শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশাধিকারের নামে কেরালার বর্তমান নয়া জাগরণবাদীরা যা করছে তাতে শক্তিশালী হবে সেই সব জিনিস, যা নবজাগরণ আন্দোলন একসময় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল৷
সংঘ পরিবারের ‘রাম মন্দির’, ‘গো–রক্ষার’ মতো এই ‘মহিলা দেওয়াল’ আন্দোলনও একটা ভোটের চমক৷ কেরালা সরকারের এই অবিবেচনা প্রসূত পদক্ষেপ বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে৷ নিঃসন্দেহে কেরালার জনগণকে এ জন্য অনেক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হবে৷
শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশাধিকার সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় নিছক কানুনি দৃষ্টিতে সঠিক৷ কিন্তু, রাজনৈতিক আন্দোলন বিশেষ করে বিপ্লবী আন্দোলনের নেতা–কর্মীদের পদক্ষেপ নিতে হয় সময়ের দাবিকে বিচার করে৷ বর্তমান সময়ের দাবি হল নবজাগরণ আন্দোলনের অসমাপ্ত কর্মসূচিগুলিকে সমাপ্ত করা৷ জাগতিক ঘটনাবলিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা৷ দৈনন্দিন জীবনযাপনকেও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দ্বারা পরিচালিত করার কাজে জনগণকে শিক্ষিত করা এবং অভ্যস্ত করে তোলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে হবে৷ কিন্তু সিপিএম নবজাগরণের নামে যা করছে, তা এ কাজে সাহায্য তো করবেই না, বরং অন্ধতা বাড়াবে৷ এর দ্বারা প্রতিক্রিয়াশীল জাতপাতবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিই লাভবান হবে৷ মহিলারা শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশ করতে পারলে নবজাগরণের কোন অপূরিত কাজটি সম্পূর্ণ হবে?
সাম্প্রদায়িকতাকে পরাস্ত করা এবং জনগণের ঐক্য রক্ষা করার একটিই রাস্তা– গণতান্ত্রিক আন্দোলন৷ জীবনের সমস্যাকে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করার শিক্ষা দিতে পারে একমাত্র গণআন্দোলন৷ এ ছাড়া, অন্য কোনও সহজ রাস্তা নেই৷ পুঁজিবাদী শোষণে পিষ্ট জনগণকে ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসাবে টেনে আনতে হবে আন্দোলনের রাস্তায়৷ বাস্তব যে সমস্যাগুলি তাদের সকলের জীবনকে ছারখার করে দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে উন্নত নৈতিকতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ এটাই নবজাগরণ আন্দোলনের সত্যিকারের ধারাবাহিকতা৷ সিপিএমের ‘মহিলা দেওয়াল’ আন্দোলন সেই পথ ধরেনি৷