‘যদি গুলি চালায় পুলিশ, তাহলে কী করবেন?’– দিল্লিতে কৃষকদের ধরনায় এক প্রবীণ কৃষককে প্রশ্ন করেছিলেন মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের চিকিৎসক ডাঃ মৃদুল সরকার। রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা, খেতে কাজ করা, কড়া-পড়া মেহনতি হাত তুলে ধরে কৃষকের বলিষ্ঠ উত্তর, ‘কয়েক যুগ ধরে ট্রাক্টর চালাচ্ছি। এই হাত অবহেলা করার নয়। এই হাত দিয়েই এর মোকাবিলা করব।’
আন্দোলন মোকাবিলায় সরকারের হাতিয়ার যখন পুলিশ-মিলিটারি-জলকামান-টিয়ারগ্যাস-লোহার ব্যারিকেড-কয়েক মণ ওজনের ট্যাঙ্কার-কাঁটাতারের বেড়া কিংবা আইন সংশোধনের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, একের পর এক ধাপ্পা, তখন খেতে-খামারে কাজ করা কৃষক-খেতমজুররা কৃষি আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়পণ করেছেন নিজেদের হাত দুটো সম্বল করে। হরিয়ানার সিংঘু বর্ডারে ১২ কিলোমিটার ধরে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার ট্রাক্টরে আসা লক্ষ লক্ষ কৃষক প্রতিনিধির এমনই দৃপ্ত ভঙ্গি তাই সারা দেশে জাগিয়েছে আন্দোলনের বান।
এই কৃষকদের চিকিৎসা পরিষেবা দিতে ২ ডিসেম্বর থেকে সিংঘু বর্ডারে মেডিকেল ক্যাম্প শুরু করেছে মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার (এমএসসি)। কৃষক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ উদ্বোধন করেছেন ক্যাম্পের। সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক ডাঃ অংশুমান মিত্রের নেতৃত্বে একটি দল কৃষকদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে দিল্লি ছুটে যান। তাতে যোগ দেন স্থানীয় ও আশপাশের রাজ্যগুলি থেকে আসা ওই সংগঠনের ডাক্তার-নার্সরা। ধর্ম-বর্ণ-ভাষার ব্যবধান হার মেনেছে মানবিকতার কাছে। কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহচর্য আন্দোলনকারীদের মনোবল কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ৭২ বছরের এক বৃদ্ধা চিকিৎসা শিবিরে এসেছেন প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে। তাঁর শারীরিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে চিকিৎসকরা বাড়ি ফিরে যেতে বললে এককথায় তা নস্যাৎ করে দেন। বলেন, ‘মরতে হয় এখানেই মরব। সরকার কৃষি আইন প্রত্যাহার করুক, না হলে এখান থেকে কিছুতেই নড়ব না।’ এই দৃঢ়তা, এই প্রত্যয়, এই সংগ্রামী মনোবল অসংখ্য বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে। শুধু তিনিই নন, তাঁর মতো অনেক কৃষক-মজুরই এসেছেন হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, হার্ট, শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি এবং চোখ ও ত্বকের নানা রোগ নিয়ে। দিল্লির কনকনে ঠাণ্ডায়, কুয়াশায়, দূষণযুক্ত পরিবেশে অসুস্থও হয়ে পড়ছেন অনেকেই। আবার কেন্দ্রীয় সরকারের পুলিশের জলকামান-টিয়ারগ্যাস আক্রমণে বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পুলিশের সাথে ব্যারিকেড ফাইটে হাত-পা ভেঙেছে অনেকের। তা সত্ত্বেও লড়াইয়ের মাটি ছেড়ে যাবেন না তাঁরা। আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কাছে শারীরিক কষ্ট, রোগ সবই গৌণ হয়ে গেছে।
এঁদের সকলের চিকিৎসা করছেন মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের ডাক্তার-নার্সরা। ওষুধ ফুরিয়ে যাওয়ার পর অমৃতসর থেকে ইন্টার্নরা অনেক ওষুধপত্র সরবরাহ করেছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত চলছে স্বাস্থ্যশিবির। বহু ছাত্র-যুবক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এগিয়ে এসেছেন। ক্যাম্পে সাহায্য করতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছেন সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সদস্যরাও। অত্যন্ত সুশৃঙ্খলা এবং ধৈর্য সহকারে রোগীরা লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধপত্র নিচ্ছেন। বয়স্কদের সাহায্য করছে ছোটরা। রোগী দেখতে দেখতে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা আন্দোলনের উত্তাপ অনুভব করছেন। এ এক নতুন আন্দোলন, যাতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে কৃষক-খেতমজুর, আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী কৃষক নেতা থেকে আন্দোলনে প্রেরণা জোগানো প্রতিটি মানুষ। রাতে লঙরখানায় রুটি, ডাল, সবজি খেয়ে কৃষকদের সাথে তাঁবুতে ঘুমাতে যাচ্ছেন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা পরের দিনের কর্তব্য পালনের তাগিদ নিয়ে। আবার কখনও আপৎকালীন পরিস্থিতিতে রাতেও রোগী দেখার ডাক পড়ছে এঁদের, ছুটে যাচ্ছেন রোগী দেখতে।
ধরনা স্থলে ট্রাক্টরে হ্যান্ড মাইক নিয়ে বসে কয়েকটি স্কুল ছাত্র স্লোগান দিচ্ছিল– ‘কৃষক একতা জিন্দাবাদ।’ স্কুল ছেড়ে এখানে কেন? প্রশ্ন করায় চটজলদি উত্তর ‘আমরা সেবা করতে এসেছি।’ অমৃতসর থেকে আসা ওই ছাত্রের মা-র কাছে জানতে চাওয়া হল এই ভয়ানক ঠাণ্ডায়, পুলিশি হামলার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও কেন এনেছেন ওদের? তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘এরা ছোট থেকেই জানুক, বুঝুক সবকিছু। তাহলেই বড় হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখবে।’ এই না হলে ভগৎ সিং-এর মাটি! ফাঁসির আগে জেলে লোহার গরাদের বাইরে থেকে ভগৎ সিং-এর মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলেছিলেন, ভগনওয়ালা, কিছুতেই আদর্শ বিসর্জন দিও না। তুমি এমনভাবে জীবন বিসর্জন দেবে যা দেখে ঘরে ঘরে মায়েরা প্রার্থনা করবে তাদের সন্তান যেন ভগৎ সিং-এর মতো হয়। আজকের এই মায়েরা তো বাস্তবে তাঁদেরই উত্তরসূরি। ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কম তাপমাত্রায় ঘরেই যখন বেশ কাবু হয়ে পড়েছেন রাজধানীর মানুষ, তখন ধরনাস্থলে আসা বহু জনই ট্রাকের নিচে, না হয় খোলা আকাশের নিচে কম্বলে জড়াজড়ি করে কোনওরকমে রাত কাটাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই ২২ জন শহিদের মৃত্যু বরণ করেছেন ঠাণ্ডায় ও দুর্ঘটনায়। এই হার না মানা আন্দোলনে আদর্শ কে? উত্তর আসছে ভগৎ সিং, আসফাকউল্লা খান। তাই সরকার যতই বিভ্রান্তি ছড়াক, ভয় দেখাক– সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে জীবনপণ করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন নানা রাজ্য থেকে আসা কৃষিজীবী মানুষ ও তাদের পরিজনরা। মহিলা থেকে শিশু, যুবক থেকে প্রবীণ সকলেই এই প্রত্যয় নিয়ে ধর্নায় রয়েছেন– হয় দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করব, না হয় এখানেই মরব।