ক্ষোভে ফুঁসছে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি। দারিদ্র, বেকারি, ছাঁটাই, দুর্নীতিতে জর্জরিত, কোভিড পরিস্থিতিতে কাজ হারানো, চিকিৎসা না পাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতি জনবিরোধী সরকারগুলির দায় ঝেড়ে ফেলার মনোভাবের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ দলে দলে বিক্ষোভে রাস্তায় নামছে সেখানে।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা আজ এগিয়ে চলার শক্তি হারিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ায় গোটা পৃথিবী জুড়েই গরিবি, বেকারি, দুর্নীতির ভয়াল সমস্যায় জনজীবন জেরবার। ল্যাটিন আমেরিকাও ব্যতিক্রম নয়। আর পাঁচটা পুঁজিবাদী দেশের মতো এই অঞ্চলের দেশগুলিতেও সরকার এই সংকটের দায় কোভিড অতিমারির ওপর চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বাস্তবে এই মারণ-রোগ হানা দেওয়ার অনেক আগে থেকেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিজস্ব নিয়মে প্রবল আর্থিক মন্দায় ধুঁকছে দেশগুলি। কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্দশার কালো ছায়া ঘনিয়েছে। এর ওপর এসেছে কোভিড অতিমারির ধাক্কা। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। অপদার্থ সরকারগুলির বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন তাঁরা। গত বছর একের পর এক বিক্ষোভের ঢেউ দেখেছে ল্যাটিন আমেরিকা। এ বছর পুলিশি বর্বরতা অগ্রাহ্য করে আরও বেশি মানুষ রাস্তায় নামছেন।
চিলিতে ভেঙে পড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা, ‘ফুড ফর চিলি’ প্রকল্পে সরকারি অপদার্থতা এবং প্রাপ্য পেনসনের দাবিতে লকডাউন অগ্রাহ্য করে জুলাই মাসের মাঝামাঝি ব্যাপক বিক্ষোভ দেখান মানুষ। বিক্ষোভকারীদের উপর ব্যাপক হামলা চালায় পুলিস। নির্মম অত্যাচার, ধর্ষণ, রবার বুলেটে চোখ অন্ধ করে দেওয়া ছাড়াও এক বিক্ষোভকারীকে ব্রিজের ওপর থেকে নদীতে ঠেলে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে সেখানে।
ব্রাজিলে এ’বছরের প্রথম ছ’মাসে তিন হাজারেরও বেশি বিক্ষোভকারী পুলিশি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। মেট্রোর ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভের যে বিস্ফোরণ শুরু হয়েছিল, ক্রমে তার আগুন ছড়িয়ে পড়ে ব্যয়সংকোচের নীতি মেনে সরকারের সামাজিক খাতে খরচ কমানোর প্রতিবাদে। সাম্প্রতিক অতিমারি পরিস্থিতিতে জনসাধারণের দুর্দশায় সরকারের উদাসীনতার বিরুদ্ধেও ক্ষোভের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সে দেশে।
কলম্বিয়া ল্যাটিন আমেরিকার আরেকটি দেশ। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি মকুবের দাবিতে বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীরা ‘ন্যাশনাল পেডাগজিক্যাল ইউনিভার্সিটি’-র ক্যাম্পাস দখল করে নেয়। যথারীতি পুলিশ সন্ত্রাস চালায় তাদের ওপর। বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়।
মেক্সিকোয় আন্তর্জাতিক নারী দিবসে হাজার হাজার মহিলা বিক্ষোভ দেখান। নারী নির্যাতন বন্ধ ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নামেন তাঁরা।
পানামা গত কয়েক মাসে সাক্ষী থেকেছে একের পর এক বিক্ষোভের। দরিদ্র, কাজ-হারা মানুষ উদাসীন সরকারের বিরুদ্ধে জীবনের দাবিতে পথে নেমেছে। অবিলম্বে ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসা-সরঞ্জামের অভাব মেটাতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে– দাবি তুলেছেন পানামার বিক্ষোভকারীরা।
আর্জেন্টিনায় গভীর আর্থিক মন্দায় জর্জরিত মানুষ খাদ্য ও কাজের দাবিতে পথে নেমেছেন।
ইকুয়েডরে বামপন্থী ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষ জ্বালানিতে সরকারি ভর্তুকির দাবিতে গত বছর তুমুল বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। সম্প্রতি লকডাউন অগ্রাহ্য করে সেখানকার মানুষ ছাঁটাই ও বেতন হ্রাসের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। অতিমারিতে বেকারত্ব বিপুল হারে বেড়েছে ইকুয়েডরে।
গত মাসে রাষ্ট্রসংঘের এক রিপোর্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিতে বেকার সমস্যা আরও তীব্র হতে চলেছে। ফলে আসন্ন দিনগুলিতে এই এলাকায় দারিদ্রের অন্ধকার দিনে দিনে আরও গভীর হয়ে উঠতে চলেছে– এ কথা বলাই যায়। এও বলা যায়, অসহনীয় জীবনযন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা মানুষ আগামী দিনে আরও অসংখ্য বিক্ষোভে কাঁপিয়ে তুলবে রাজপথ। জনবিরোধী সরকারগুলির পুলিশের হিংস্র লাঠি বা বুলেট ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না তাদের। বার বার তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে লড়াইয়ের ময়দানে। বার বার মার খাবে। অবসান চাইবে জীবনযন্ত্রণার।
ঠিক একই পরিস্থিতি ভারতেরও। গরিবি, বেকারি, চুরি, দুর্নীতিতে জর্জরিত ভারতের মানুষও প্রবল ক্ষোভে বারবার রাস্তায় নামছে। পুলিশের লাঠি-গুলি অগ্রাহ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিবাদী বিক্ষোভে। কিন্তু অন্যায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ওপর মানুষের শোষণকে হাতিয়ার করে গড়ে ওঠা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যতদিন না উচ্ছেদ হয়, ততদিন শত চেষ্টাতেও দূর করা যাবে না এ দুর্বিষহ পরিস্থিতি। এর জন্য চাই বিপ্লব। চাই সঠিক বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব। প্রয়োজন আশু প্রতিকারের লক্ষ্যে সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা আন্দোলনগুলিকে যথার্থ বিপ্লবী নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করে পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রস্তুতি।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা হাতিয়ার করে এই কঠিন কাজে ব্রতী ভারতের যথার্থ সাম্যবাদী দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)। দুনিয়ার শোষিত মানুষকে মুক্তির পথ দেখানো রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবের ১০৩ তম বার্ষিকী উপলক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘‘…অত্যাচারিত জনগণ আজ নির্ভীক, সাহসী ও সংগ্রামী। তারা পরিবর্তন চায়। কিন্তু তাদের সামনে বিপ্লবী আদর্শ, উন্নত সংস্কৃতি বা সংগঠন ও নেতৃত্ব নেই। ফলে এই মুহূর্তে সর্বাধিক প্রয়োজন সকল দেশেই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে হাতিয়ার করে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী দল গড়ে তোলা ও শক্তিশালী করা। …”
বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে সমাজবিকাশের ইতিহাস বিচারে এটিই গণমুক্তির একমাত্র রাস্তা।