আবারও প্রতারণার শিকার দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক। নীরব মোদী-মেহুল চোক্সী কাণ্ডের ১৪ হাজার কোটি টাকা প্রতারণার ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে আরও ধাক্কা এসে পড়ল পিএনবি-র উপর। ‘আইএল অ্যান্ড এফএস তামিলনাড়ু পাওয়ার’ নামে একটি সংস্থা পিএনবি থেকে ২০৬০.১৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করেছে। ঋণ অ্যাকাউন্টটিকে অনুৎপাদক সম্পদ (এনপিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের ঋণ অ্যাকাউন্টকে ‘স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট (এসএমএ) হিসেবে চিহ্নিত করেছে পিএনবি। একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত কোনও ঋণের আসল অঙ্ক অথবা সুদ কোনওটাই না মেটানো হলে, সেই অ্যাকাউন্টকে এসএমএ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
পিএনবি এই ধাক্কা কতখানি সামলাতে পারবে তার চেয়েও বড় প্রশ্ন কী উপায়ে সামলাবে? হয় ব্যাঙ্কের লাভের থেকে কিংবা সরকারি তহবিল থেকে এই ঋণ পরিশোধ হবে। উভয় ক্ষেত্রেই জড়িয়ে আছে আমজনতার স্বার্থ। বলা বাহুল্য, এসব বড় বড় ঋণের ক্ষেত্রে সরকারের একটা ভূমিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে থেকেই থাকে। সরকারি মদতে বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সীরা যেমন আপাত নিরাপদ আস্তানা খুঁজে নিতে পেরেছে, তেমন সরকারি বদান্যতার হাত এই প্রতারকদের দিকেও প্রসারিত হবে না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না।
গত ১৩ বছরে অর্থাৎ ২০০৮-০৯ থেকে ২০২০-২১ অর্থবর্ষ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির মোট কার্যকরী (অপারেটিং) লাভ ছিল ১৫ লক্ষ ৯৭ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১৪ লক্ষ ৪২ হাজার ১ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ পরিশোধের জন্য আলাদা করে রাখতে হয়েছিল। আর একটি হিসাবে দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০২১, এই ২১ বছরে দেশের সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ৯ লক্ষ ৮৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ মকুব করে দেওয়া হয়েছে। এভাবেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে দুর্বল করা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়াকে জোরদার করা হচ্ছে। অথচ ইতিহাস হল, ১৯১৩ থেকে ১৯৬৮, এই ৫৬ বছরে ২১৩২টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক নানা কারণে ফেল করেছে। ডুবে গিয়েছে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ। কর্মচারীরা হারিয়েছেন তাঁদের কাজ। ১৯৬৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক, ভারত ওভারসিজ ব্যাঙ্ক, লক্ষ্মী বিলাস ব্যাঙ্ক, ইয়েস ব্যাঙ্কের মতো ২৫টি মরণাপন্ন বেসরকারি ব্যাঙ্ককে বাঁচাতে এসবিআই, পিএনবি, ব্যাঙ্ক অফ বরোদা, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি এগিয়ে গিয়েছে।
কর্পোরেট কর্তাদের ঘনিষ্ঠমহল প্রচার করছে, ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ কমানোর অন্যতম উপায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বেসরকারিকরণ। বলা হচ্ছে, প্রকল্পের ঝুঁকি, সংস্থার আর্থিক পরিস্থিতি কিংবা ওই প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব যাচাই করে তবেই কোনও সংস্থাকে বড়সড় ঋণ দেয় বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি যা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি করে না। সে কারণেই নাকি বেসরকারি ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের তুলনায় কম। এটা একেবারেই মিথ্যা প্রচার। প্রথমত, যে কোনও বড় ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রকল্পের খুঁটিনাটি বিচার করতে হয় সব ব্যাঙ্ককেই। সেখানে ভুল-ত্রুটি থাকে না এমন নয়। তবে এর বাইরে যা থাকে তা হল শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী এবং আমলাদের অবৈধ যোগসাজশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ দিতে বাধ্য করা। দ্বিতীয়ত, অনুৎপাদক সম্পদের সমস্যা বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিতেও কম নয়। সম্প্রতি ঋণখেলাপির আর একটি বড় উদাহরণ হল গুজরাতের এবিজি শিপইয়ার্ড সংস্থার ২২,৮৪২ কোটি টাকা প্রতারণা। এটিই আপাতত সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক প্রতারণা। মোট ২৮টি সরকারি বেসরকারি ব্যাঙ্ক এই খেলাপির ভুক্তভোগী। এর মধ্যে বেসরকারি আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের লোকসানের পরিমাণ ৭০৮৯ কোটি টাকা। এর পরই রয়েছে আইডিবিআই ব্যাঙ্ক, এসবিআই, ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, পিএনবি, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক, যাদের লোকসানের পরিমাণ যথাক্রমে ৩৬৩৪, ২৪৬৮, ১৬১৪, ১২৪৪, ১২২৮ কোটি টাকা।
দেশে মোট ব্যাঙ্ক আমানতের ৭০ শতাংশ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে মোট জমা টাকার পরিমাণ ১০০ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। সরকারের সহায়তায় এই বিশাল পরিমাণ টাকার নিয়ন্ত্রক হতে চাইছে এদেশের ধনকুবের গোষ্ঠী। বলা বাহুল্য, এই টাকার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ঋণ দিয়ে থাকে ব্যাঙ্কগুলি। ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণ ক্রমবর্ধমান। এই ঋণ না আদায়ের ফলে এগুলি ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ বা এনপিএ-তে পরিণত হচ্ছে। এই সম্পদ ব্যাঙ্ক-ব্যবস্থাকে দিনে দিনে দুর্বল করে দিচ্ছে। এই অনাদায়ী ঋণের সিংহভাগ হল বৃহৎ পুঁজির মালিকানাধীন বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার। এনপিএ কমাতে সরকার বহু ক্ষেত্রে বড় বড় কর্পোরেট ঋণ মকুব করে দিচ্ছে। গত তিন অর্থবর্ষে মোট ‘রাইট অফ’ বা ঋণ মকুবের পরিমাণ ৪ লক্ষ ৯০ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। অনুৎপাদক সম্পদের বোঝা কমানোর নামে এখন আবার ‘ব্যাড ব্যাঙ্ক’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মাধ্যমে এনপিএ কমার সম্ভাবনা নিয়ে অর্থনীতিবিদরাও কোনও আশার আলো দেখাতে পারছেন না। এদিকে আবার কর্পোরেট ঋণ আদায়ে সরকার দেউলিয়া বিধি এনেছে। এই বিধি অনুযায়ী ঋণখেলাপি সংস্থাগুলিকে দেউলিয়া ঘোষণা করার দাবি নিয়ে ব্যাঙ্কগুলি আদালতে যাবে। তারপর উক্ত সংস্থা নিলামে তুলে তারা বকেয়া পাওনা উদ্ধার করতে পারবে। এর মধ্য দিয়েও বাস্তবে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে রেহাই দেওয়া হচ্ছে। এসার, ভূষণ স্টিল, ডিএইচএফএল, ভিডিওকন সহ ১৩টি বড় বড় কোম্পানি বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে ৪ লক্ষ ৪৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেনি। সরকারের অনুৎপাদক সম্পদ কমানোর লক্ষে্য আনা দেউলিয়া আইনে রফা হয়েছে, মোট ১ লক্ষ ৬১ হাজার ৮২০ কোটি টাকা দিলে সবাইকে ঋণ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। এর ফলে ব্যাঙ্কগুলির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াল ২ লক্ষ ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ কর্পোরেটদের সুবিধা দিতে ব্যাঙ্কগুলিকে ৬৪ শতাংশ ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে। এই অবস্থার মধ্যেই চলছে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের তোড়জোড়। এর মধ্য দিয়ে জনগণের অর্থকে আরও যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যাবে এই কর্পোরেট সংস্থাগুলি। বর্তমানে ব্যাঙ্কগুলিকে দুর্বল করার জন্য যারা মূলত দায়ী ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের পরে তারাই হয়ে যাবে ব্যাঙ্কের মালিক। জনস্বার্থেই ব্যাঙ্ক কর্মচারী ও সাধারণ গ্রাহকরা এই সর্বনাশা বেসরকারিকরণের নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় না নামলে অচিরেই গরিব-মধ্যবিত্তের কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের পুরোটা ঢুকবে ধনকুবেরদের সিন্দুকে।