প্রধানমন্ত্রী থেকে অর্থমন্ত্রী এতদিন সকলেই বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করে আসছিলেন, দেশের আর্থিক পরিস্থিতি খুবই ভাল, কারণ আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ছে৷ যদিও সেটি যে কী বস্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ তার কোনও হদিশ পায়নি৷ মন্ত্রীদের এইসব দাবি যে আসলে শূন্যগর্ভ বাগাড়ম্বর, দেশের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে৷ তেলের দাম লাফিয়ে বাড়ছে, একই রকমভাবে কমছে টাকার দাম৷ জনজীবনে এর ফল মারাত্মক৷ দেশীয় বাজারে পেট্রল একশো টাকা ছুঁতে চলল৷ কাছাকাছি ডিজেলও৷ লাফিয়ে বাড়ছে পরিবহণ খরচ৷ ফলে বাড়ছে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে ভোগ্যপণ্য– সব কিছুর দাম৷ সরকার বেপরোয়া ভাবে বাড়াচ্ছে রান্নার গ্যাসের দাম৷ সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনিরসনীয় সংকটের কারণেই দেশের আর্থিক পরিস্থিতি ভেতরে ভেতরে অনেক দিন ধরেই ক্ষয়ে আসছে৷ কিন্তু এই ক্ষয়িষ্ণু ব্যবস্থার সেবক ও রক্ষক সরকারি দলগুলির পক্ষে তা স্বীকার করা সম্ভব নয়৷ তাই অতীতের কংগ্রেসের মতোই বর্তমান বিজেপি সরকারের নেতা–মন্ত্রীরা প্রাণপণে তা চেপে রাখার চেষ্টা করছিলেন৷ কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বেশ খানিকটা বেড়ে যেতেই বেসামাল অবস্থা সরকারের৷ সরকারের অপরিণামদর্শিতা এবং সমস্ত অপদার্থতার বোঝা শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় খরচগুলিও কমাতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ৷ ভোগ্যপণ্যের বাজারেও সংকট দেখা দিচ্ছে৷ মার খাচ্ছে উৎপাদন শিল্প৷ ডিজেলের দামবৃদ্ধি দেশের কৃষকদের উপর মারাত্মক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে৷ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামে লাগাম পরার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, উপরন্তু ইরান থেকে তেলের আমদানিও মার্কিন হুমকিতে অনেকখানি কমতে চলেছে, যা সংকট আরও বাড়িয়ে তুলবে৷ তেমনই টাকার দাম নামতে নামতে কোথায় গিয়ে থামবে তারও কেউ আন্দাজ দিতে পারছে না৷
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি মিলিয়ে তেলের দামের অর্ধেকের বেশি পরিমাণ ট্যাক্স নেয়৷ তেল কোম্পানিগুলি আকাশছোঁয়া মুনাফা করে চলেছে৷ জনজীবনের বোঝা কমাতে যেখানে জরুরি ছিল এই ট্যাক্স ব্যাপক হারে কমিয়ে দেওয়া, সেখানে চার রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের সামনে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকার মাত্র ১.৫০ টাকা এবং তেল কোম্পানিগুলি ১ টাকা মিলিয়ে ২.৫০ টাকা এবং রাজ্য সরকার এক টাকা দাম কমিয়েছে৷ এই অতি তুচ্ছ পরিমাণ দাম কমাতে না কমাতে আবারও দাম বাড়ছে, যাতে কমানো দামটুকু দ্রুত শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে৷
ভারত প্রয়োজনীয় তেলের ৮০ শতাংশই আমদানি করে৷ একদিকে টাকার দাম কমা, অন্য দিকে তেলের দাম বাড়া, দুইয়ে মিলিয়ে তেলের আমদানি খরচ বাড়ছে হু হু করে৷ ফলে টান পড়ছে ডলারের জমা ভাঁড়ারে৷ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ডলারের দাম এক টাকা বাড়লেই তেল আমদানির খরচ ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়ে৷ জানুয়ারি থেকে এখনও পর্যন্ত ডলারের দাম ১১ টাকা বেড়েছে৷ ফলে তেলের আমদানি খরচ কী পরিমাণে বেড়েছে বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ এই দুরবস্থার কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া যেত যদি রফতানি বাড়িয়ে ডলারের আমদানি বাড়ানো যেত৷ কিন্তু মহামন্দা আন্তর্জাতিক বাজারকে আজও ছেয়ে আছে৷ ফলে রফতানি শিল্পকে নানা রকম ছাড়, সুযোগ–সুবিধা দিয়েও রফতানি বাড়ানো যাচ্ছে না৷ এবার অবধারিত ভাবে সরকার প্রকাশ্যে এবং গোপনে জনসাধারণের উপর আরও বোঝা চাপিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করবে৷
শুধু টাকার দাম কমছে এবং বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার কমছে তাই নয়, সরকারি নীতির কারণে কর্মসংস্থানে মারাত্মক অধোগতি দেশের কোটি কোটি বেকার যুব সমাজের সামনে গভীর অন্ধকার নামিয়ে এনেছে৷ কোনও নতুন কলকারখানা হচ্ছে না, একটা হলে একশোটা বন্ধ হচ্ছে, নতুন কারখানা দু–একটা হলেও সেগুলি সবই উচ্চপ্রযুক্তি পরিচালিত৷ চাকরি প্রায় হচ্ছে না বললেই চলে৷ সরকার শূন্য পদগুলি দ্রুত অবলুপ্ত করে দিচ্ছে৷ স্থায়ী চাকরি বন্ধ করে দিচ্ছে৷ সবই চুক্তিতে৷ সব মিলিয়ে বঞ্চনা ও প্রতারণা ছাড়া সরকারের কাছ থেকে জনসাধারণের আর কিছুই পাওয়ার নেই৷ অথচ জনগণের প্রতি সরকারের ন্যূনতম দায়বদ্ধতা থাকলে সরকার ট্যাক্স কমিয়ে তেলের দামে স্থিতাবস্থা রক্ষা করত৷ অন্য দিকে পুঁজিপতিদের ট্যাক্স সহ যে বিপুল পরিমাণ ছাড় দিয়ে চলেছে সে সব ছাঁটাই করত৷ সরকারি নেতা–মন্ত্রীদের যোগসাজশে বিরাট সংখ্যক পুঁজিপতি ব্যাঙ্কগুলি থেকে জনগণের জমানো টাকা লোপাট করে চলেছে৷ এই প্রতারণায় নিত্যনতুন পুঁজিপতির নাম বেরিয়ে আসছে৷ উল্টোদিকে সরকার জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকেই এই লোপাটের ফলে ব্যাঙ্কগুলির যে বিপুল ঘাটতি তা পূরণ করে দিচ্ছে৷ এ জিনিস কংগ্রেস আমল থেকেই চলছে৷ বিজেপি শাসনে তা লাগামছাড়া আকার নিয়েছে৷ জনগণ যখন ক্রমাগত দুর্ভোগের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে তখন সরকারগুলি দেশরক্ষার নামে আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্রচুক্তি করে দেশি–বিদেশি অস্ত্রব্যবসায়ীদের মুনাফার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে৷ ফ্রান্সের সাথে রাফাল বিমান কেনার চুক্তিতে অনিল আম্বানিদের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে মোদি সরকার৷ বাস্তবে শাসক দলগুলির কাছে দেশ মানে শুধু দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি৷ তাদের স্বার্থ রক্ষাই এই দলগুলির কাছে দেশরক্ষা৷ তাই সরকার বদলে এই নীতির বদল হবে না, জনগণের দুর্ভোগও কমবে না, যতক্ষণ না এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বদল হচ্ছে৷ জনগণকে সচেতনভাবে সেই বদলের লড়াইয়ে এগিয়ে আসতে হবে৷ যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন মানুষের দুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে৷
(৭১ বর্ষ ১১ সংখ্যা ১২ – ১৮ অক্টোবর, ২০১৮)