লড়াইয়ের অঙ্গীকারে ভাস্বর

 শীতের জানুয়ারিতে আন্দোলনের উত্তাপের ওম ছড়িয়ে দিলেন হেদুয়া পার্ক চত্বরে জমায়েত ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। প্রধান দাবি অভয়ার ন্যায়বিচার। আদালতের রায় ঘোষিত হলেও জনতার আদালত তা মানেনি। ন্যায়বিচারের দাবিকে প্রধান দাবি হিসেবে সামনে রেখেই জনজীবনের অন্যান্য জ্বলন্ত দাবি-দাওয়া নিয়ে সংগ্রামী বামপন্থী দল এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলের আহ্বানে মহামিছিলে শামিল হয়েছিলেন পশ্চিমবাংলার সংগ্রামী জনতা। মিছিলের শৃঙ্খলায় স্লোগানের কম্পনে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এই মহামিছিল কলকাতার রাজপথে ঢেউ তুলে গেল। একদা পশ্চিমবাংলায় বামপন্থী গণআন্দোলনের জনজোয়ারে মানুষ যে মর্যাদাময় জীবন অর্জনের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় এই মহামিছিল যেন সেই মুহূর্তকে ফিরিয়ে আনছিল।

দুপুর ১২টার আগে থেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষের ঢল নামছিল হেদুয়া পার্ক লাগোয়া বিধান সরণিতে। দার্জিলিং জেলার ফুলবাড়ি এলাকা থেকে এসেছেন চা বাগানের শ্রমিক ফুলমতী ওঁরাও। এক রাতের ট্রেন সফরের ক্লান্তির ছাপ চোখে মুখে যথেষ্ট। তবুও লড়াইয়ের স্পৃহা একটুও কমেনি।

‘এতটা পরিশ্রম করে কলকাতায় এসেছেন মহামিছিলে যোগ দিতে? কিসের টানে?’ প্রশ্ন শেষ হওয়া মাত্রই তার সটান উত্তর, ‘নিজের হকের লড়াই বুঝে নিতে’। মুর্শিদাবাদের সুতি থেকে কানন দাস, প্রফুল্ল মণ্ডল, মনিরুল ইসলাম, মোদাসর হোসেন, রিজিয়া বিবিরা এসেছেন একদিনের কাজ কামাই করে। দিনে হাজার বিড়ি বেঁধেও যে মজুরি পান তাতে দিন গুজরান করাটা কঠিন। রয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিত্যদিন কাজের ফলে নানা রোগের সাথে সহবাস। শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি এই মিছিলের অন্যতম দাবি। এই দাবি বিড়ি কারখানার মজুরদেরও। মিছিলের স্রোতে মিশে যাচ্ছে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা, বারাসাত থেকে মালদহ, জলপাইগুড়ি থেকে বসিরহাট। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগরের উত্তর দুর্গাপুর গ্রাম থেকে এসেছেন গৃহবধূ মিলি গাঙ্গুলী। তার ৬ বছরের সন্তানের হাত ধরে মিছিলে হাঁটছেন। বহু মা তার সন্তানকে কোলে নিয়ে হাঁটছিলেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্যই তাঁরা দৃপ্ত কণ্ঠে মিছিলে স্লোগান দিচ্ছেন।

হেদুয়ার সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য

এমন সংগ্রামী জনতার মিছিলে সংগ্রামী ছাত্র-জনতার ঢেউ গমকে গমকে উঠবে তাই তো স্বাভাবিক। তাঁরা দাবি তুলেছেন রাজ্যের সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচাবার যে লড়াই তাকে আরও তীব্রতর করার জন্য, দাবি তুলেছে, সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতি প্রতিরোধ করার। তাই গোটা পশ্চিমবাংলার স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এই মিছিলে পা মিলিয়েছেন। রাজ্যের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের ছাত্ররাও এই মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। তাদেরই একজন কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন ডাক্তার মৃন্ময় বসাক মিছিলে হাঁটতে হাটতে বলছিলেন, ‘অভয়ার মৃত্যু প্রাতিষ্ঠানিক মৃত্যু। এই মৃত্যুর পেছনে স্বাস্থ্য-শিক্ষায় দুর্নীতির যে ঘুঘুর বাসা রয়েছে তাকে ভাঙাটাও এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি। আজকের মিছিলে আমরা সোচ্চার হয়েছি সেই দাবির সমর্থনেই।’

মিছিলের শেষ ভাগ যখন ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিং ছুঁয়ে ফেলেছে, পশ্চিমদিগন্তে তখন সূর্য ডুবতে চলেছে। সেই নেমে আসা আঁধারের মুহূর্তেই আলো ফুটে উঠছে শেষ স্লোগানের প্রত্যয়ে। মিছিল যেন বলে উঠছে ‘আমরা লড়ব, আমরা জিতব।’