করোনার জন্য লকডাউন চলছে নয় নয় করেও দু’সপ্তাহ। আরও কত দিন চলবে তার ঠিক নেই। দিন আনা-দিন খাওয়া মানুষগুলো কেমন আছেন, গণদাবীর পক্ষ থেকে ঘুরে দেখা হল। দেখা গেল, প্রশাসনের বারবার সাহায্যের আশ্বাস সত্ত্বেও বহু স্থানেই পৌঁছয়নি কোনও সাহায্য। খাবার, ওষুধ, আর্থিক সহায়তা না পেয়ে এই মানুষগুলি গভীর উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রয়েছেন কয়েক হাজার দর্জি শ্রমিক। সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান এঁরা। এঁদের কোনও সরকারি স্বীকৃতি নেই। লকডাউনে এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন তাঁরা।
কৃষ্ণচন্দ্রপুর অঞ্চলের কাটানদিঘি গ্রামের দর্জি শ্রমিক আলাউদ্দিন সরদার সপ্তাহে পনেরোশো থেকে আঠারোশো টাকা উপার্জন করতেন আগে। মেটিয়াবুরুজ থেকে জামাকাপড়ের বান্ডিল যেত গাড়ি করে। সেলাই হয়ে গেলে মিলত মজুরির টাকা। এখন সব বন্ধ। প্রশাসনের কাছ থেকেও কোনও সাহায্য পাচ্ছেন না। ভাবছেন বিডিওর সাথে দেখা করে চাল ডাল আলু যাতে পাওয়া যায় তার চেষ্টা করবেন। না হলে না খেতে পেয়ে মরতে হবে এই পরিবারের সাত সদস্যকে। কলকাতায় সুতো কারখানায় কাজ করতেন ওই জেলার সাইফুল নস্কর। সুতোর বান্ডিল বেঁধে সপ্তাহে পেতেন ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা। বাড়িতে চাল শেষ। যতটুকু জমানো টাকা ছিল তাও শেষ। ছ’জনের পরিবারে নিত্য অশান্তি লেগেই রয়েছে। এইরকম দুরবস্থার মধ্যে পড়ে নিরুপায় কেউ কেউ ভাবছেন, শেষ পর্যন্ত হয়ত আমাদের সরকারি চালের গাড়িই লুঠ করতে হবে।
দর্জি শ্রমিকদের সরকারি স্বীকৃতি নেই, কিন্তু অটোচালকদের তো আছে। তাঁরা তো অসংগঠিত শ্রমিকের সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছেন। কেমন আছেন তাঁরা? প্রশ্ন করতেই এগিয়ে এলেন অটোচালক বিশ্বনাথ রুইদাস। মথুরাপুর-জয়নাল রুটে অটো চালান তিনি। বললেন, সাত জনের সংসার চালানোই দায়। ক্লাব, প্রতিষ্ঠান কখনও এক দিন, কখনও এক বেলা খাবার দিয়েছে, তার ওপর ভরসা করে কতদিন চলবে? প্রশাসনের কোনও সাহায্য পাইনি আমরা। বললেন, বিডিওর কাছে দরবার করতে যাব।
মধ্য কলকাতার ইলেকট্রিক মিস্ত্রি অশোক চৌধুরী। কাজ করে মোটামুটি সংসার চলে যায়। লকডাউনের দু’সপ্তাহ পর হাতের টাকা শেষ। চাল-ডালটুকু পর্যন্ত নেই। এ বাড়ি-ও বাড়ি কেউ চাল-ডাল দিলে তাতেই কোনও রকমে একবেলা খাচ্ছেন। বাড়িতে অসুস্থ দাদা, বিকলাঙ্গ ভাইঝি মিলিয়ে পাঁচটি পেট। আগামী দিন কিভাবে চলবে তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটের ফুলচাষিরা পড়েছেন প্রচণ্ড সমস্যায়। ফুলচাষি গৌরীশংকর ঘাঁটা, মোহন দাস বলেন কয়েক বিঘা জমিতে ফুলের চাষ করেছিলাম। বাজার বন্ধ থাকায় বাগানের ফুল ঝরছে বাগানেই। এই মুহূর্তে গাছ থেকে ফুল তুলে না নিলে গাছের উৎপাদন ক্ষমতা একেবারে কমে যাবে। শ্রমিকরা কাজে আসছে না। ফলে বাগান টিকিয়ে রাখাই দায়। সার ও কীটনাশকের দোকান বন্ধ থাকায় নতুন করে বাগান তৈরি করা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড আর্থিক সংকটের মুখে পরেছি আমরা। সারা বাংলা ফুল চাষী ও ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নারায়ণ নায়ক বলেন, ফুল চাষিদের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ ঘোষণা করুক সরকার। কারণ ফুল চাষিরা চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে।
মুর্শিদাবাদের নওদা। কয়েকশো যুবক পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন কেরালাতে। লকডাউন এর পরপরই বাড়ি ফিরে আসেন। রোজগার বন্ধ। জমানো টাকাও খরচ হয়ে গেছে কয়েক দিনে। এখন আগামী দিন কীভাবে চলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায়।
বজবজ বাওয়ালির বাসিন্দা কাকলি বানু। স্বামী শ্রীকৃষiর বানু সামান্য খেতমজুরের কাজ করেন অন্যের জমিতে। দিন শেষে কিছু টাকা পান। তাই দিয়ে কোনওরকমে সংসার চালাতেন। কিন্তু সেসব এখন বন্ধ। পঙ্গু ছেলেকে নিয়ে তিনজনের সংসার কিভাবে চলছে জানতে চাইলে কাকলি দেবী বলেন, আমি পাড়ায় চাল সংগ্রহ করতে বেরিয়েছি, যদি কিছু মেলে। স্বামী একদিন একজনের জঙ্গল পরিষ্কার করে কিছু টাকা পেয়েছিল। তাই দিয়ে চাল আলু কিনে খেয়েছি। ক্লাব থেকে চাল দিচ্ছে শুনে আনতে গিয়ে দেখি দেড় কেজি আলু আর দু কেজি চালের জন্য ১০০ টাকা করে নিচ্ছে। কিনতে পারিনি। রেশন দোকান থেকেও কিছু পেলাম না। এখন ভাবছি কী করে ছেলেটার মুখে দু’মুঠো দেব!
বাওয়ালিতে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন অজয় বায়ান। দিনে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা রোজগার। এখন সব বন্ধ। হাতে একটিও পয়সা নেই। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁর মতো অসংখ্য রাজমিস্ত্রি। তাঁরা সরকারি সাহায্যের কথা শুনেছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না কিছুই। একই অবস্থা বজবজে নদীর ধারে চটকলে কাজ করা কয়েক হাজার শ্রমিকের। লকডাউনে তাদের কাজ বন্ধ। আগামী দিনে কাজ থাকবে কি না তার কোনও নিচয়তা নেই। গ্রামে ১০০ দিনের প্রকল্পে মাটিকাটা সহ অন্যান্য কাজও বন্ধ। অসহায় এই মানুষগুলি প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরছেন।
এঁদের কথা সরকারের কান পর্যন্ত পৌঁছবে কি?