অনেক স্বপ্ন নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্র স্বপ্নদীপের অকালমৃত্যু হল। র্যাগিংয়ের নামে সিনিয়রদের ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়ে অঙ্কুরেই ঝরে গেল তার উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন, বড় হওয়ার স্বপ্ন। মর্মান্তিক এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ মানুষ চাইছেন, র্যাগিংয়ের মতো ঘৃণ্য প্রথা চিরতরে বন্ধ হোক। আর কোনও বাবা-মায়ের কোল যাতে খালি না হয়, চোখের জল ফেলতে ফেলতে দাবি তুলেছেন স্বপ্নদীপের বাবা-মাও।
স্বপ্নদীপের হাসি হাসি স্বপ্নমাখা সরল মুখখানা বারেবারে মনে ভেসে উঠছে। ঝাপসা চোখে মনে হচ্ছে এই মৃত্যু কি অনিবার্য ছিল? যারা এই দুষ্কর্মের সাথে জড়িত তাদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া দরকার। কিন্তু যে কারণে র্যাগিংয়ের নামে পৈশাচিক, অমানবিক সংগঠিত অপরাধ বারে বারে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটে চলে, অত্যাচারিত, আতঙ্কিত ছাত্রের অসহায় মুখও যাদের সম্বিত ফেরায় না, ভীত, কুঁকড়ে যাওয়া নগ্ন দেহ দেখে যারা পাশবিক উল্লাসে ফেটে পড়ে, তারা কারা? কোন পরিবেশে তাদের জন্ম ও বাড়বৃদ্ধি? তারা তো এই সমাজেরই, কেউ কেউ নিতান্ত সাধারণ পরিবারের মেধাবী ছেলে-মেয়ে। তাদের মধ্যে এই বিকৃত রুচির জন্ম হয় কী করে যে একটি ছাত্রকে অমানুষিক অত্যাচার করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পর্যন্ত তাদের হাত কাঁপে না! হত্যার নিষ্ঠুর উল্লাসে মেতে উঠতে তাদের এতটুকু দ্বিধা হয় না!
কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢিলেঢালা প্রশাসনিক অব্যবস্থা এর জন্য কম দায়ী নয়। দায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাত্র সংসদ দখলে রাখার তাগিদে ক্ষমতালোভী এক শ্রেণির ছাত্র-সংগঠনের নীতিহীন রাজনীতির সীমাহীন আস্ফালনও। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামগ্রিকভাবে ছাত্র-রাজনীতির উপর দোষারোপ অনেকেই করছেন। বিশেষত অভিযুক্তরা তথাকথিত ‘অরাজনৈতিক’ রাজনীতির ছাত্র সংগঠনের মাথা হওয়ায় এই প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু এরা এত সাহস পেল কী করে?
রাজনীতি থেকে ‘নীতি’ শব্দটা বাদ দিলে যে যথেচ্ছাচার দাঁড়ায়, তথাকথিত ‘অরাজনৈতিক’, ‘স্বাধীন’ ছাত্র সংগঠনগুলি নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছুদিন ধরেই তার নিদর্শন রেখে চলেছে। এদের অনেকের মুখে বিচ্ছিন্ন কিছু বামপন্থী বুলি শোনা যায় বটে কিন্তু প্রকৃত বামপন্থার সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই। আদর্শহীনতার কারণে দাদাগিরিই একমাত্র সম্বল এদের। ক্ষমতার মধুভাণ্ড দখলে রাখতে দিশাহীন এই ছাত্র-রাজনীতির কারবারিরা এমন হীন কাজ নেই যা করে না। মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সহ বেশ কিছু নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে তথাকথিত অ-রাজনৈতিক পরিবেশের নামে ‘উগ্র গণতান্ত্রিক’ রাজনীতির চর্চাকে মদত দেয় কর্তৃপক্ষ। আর সেই ছাত্র-রাজনীতিকে দমন করার নামে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে চায় তারা। সেজন্য শুধু সিসিটিভি বসিয়েই ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করে দায়িত্ব সারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ! তারা চায়, যাতে ছাত্রছাত্রীদের দাবি নিয়ে আন্দোলনের সুস্থ পরিবেশ না থাকে ক্যাম্পাসে। অবশ্য এ ব্যাপারে ছাত্র পরিষদ, টিএমসিপি থেকে এসএফআই– কেউ কম যায় না। সিপিএম শাসনে ২০০১-এ আর জি কর মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে ছাত্র সৌমিত্র বিশ্বাসের মৃত্যুর পিছনে ছিল এসএফআই মাতব্বররা। ছাত্র পরিষদের জমানায় হোস্টেলে হোস্টেলে এমন তাণ্ডবের কথা অনেকেরই মনে আছে। হোস্টেল এবং কলেজ জুড়ে টিএমসিপি-র তাণ্ডব মানুষের অজানা নয়। সমাজে রুচি-সংস্কৃতির ক্রমাগত নামতে থাকা মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে মদ-গাঁজা-জুয়ার আসরের সাথে সাথে নানা ধরনের যৌন অত্যাচার স্বাভাবিক ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে। আধুনিকতার মুখোশ পরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসর জমানো কিছু ছাত্র সংগঠনের নেতারা দিনের বেলায় ছাত্রদের মধ্যে ‘গণতন্ত্রের’ বুলি আওড়ে রাতের অন্ধকারে নিষিদ্ধ জিনিসের চর্চায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে, অন্যদেরও অশ্লীল, নোংরা জীবনে অভ্যস্ত করতে মেতে ওঠে। ‘ইন্ট্রো’-র নামে জুনিয়রদের উপর এরা মাত্রাছাড়া অত্যাচার চালায়। রুচি-সংস্কৃতি-মনুষ্যত্ব বিবর্জিত এই ‘দাদা’দের পিছনে অনেক প্রভাবশালীর হাত থাকায় প্রতিষ্ঠানের কর্তারাও টুঁ শব্দটি করেন না। বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে হোস্টেলে এরা মৌরসিপাট্টা চালিয়ে যায়।
তথাকথিত ‘ইন্ট্রো’-র নামে বা আসন্ন ইঁদুর দৌড়ের চাপ থেকে বাঁচার জন্য নবাগত ছাত্রের মন তৈরি করার নামে নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যা চলে, তা নবাগতদের মনকে নষ্ট করে দেয়। শুধু তাই নয়, Ragging এর পর বহু ছাত্র মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে, অনেকের ভবিষ্যৎ জীবন ছারখার হয়ে যায়। অনেকে এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মাঝপথে পড়াশুনা ছেড়ে দেয়, কেউ বা হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করে জীবনে ইতি টানে।
এর কারণ খুঁজতে গেলে যেমন সামগ্রিক ভাবে পুঁজিবাদী অসুস্থ সমাজটার দিকে তাকাতে হবে, বিশেষ ভাবে দেখতে হবে একটি দিক– আজকের দিনে পুঁজিবাদী বাজার সংকটের কারণে মালিকদের পরস্পরের মধ্যে চলে প্রায় গলাকাটা প্রতিযোগিতা। ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট, মেডিকেল ইত্যাদি ক্ষেত্রের নামি-দামি প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এই সব কর্পোরেট মালিকদের মুনাফা লাভের অন্যতম হাতিয়ার। আজ পচা-গলা পুঁজিবাদী সমাজ নিজের প্রয়োজনেই মানুষকে অমানুষ করে তোলে। অন্যকে যন্ত্রণা দিয়ে নিজের অপ্রাপ্তি ভুলবার ব্যর্থ প্রচেষ্টার দিকে ঠেলে দেয়। এ ভাবে সহজেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে তথাকথিত ‘কিলার ইনস্টিংক্ট’ গড়ে তোলার মালিকদের লক্ষ্য পূরণ হয়। সহকর্মীকেও প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে প্রয়োজনে তাকে শেষ করে দিয়েও কোম্পানির মুনাফা বাড়ানোর ট্রেনিং তাই শুরু হয় ছাত্রজীবন থেকেই। এক দল বুদ্ধিজীবী এবং সংবাদমাধ্যম ইন্ডাস্ট্রির অনুকূলে শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর পথে সওয়াল করেন। এর অন্যতম পরিণাম হিসেবে ছাত্রদের ‘কিলার ইনস্টিংক্ট’ গড়ে তোলার নামে এই অত্যাচারকে বহু প্রতিষ্ঠানের কর্তারা প্রচ্ছন্ন মদত দেন। সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে, আইআইটি, ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলি তাই র্যাগিংয়ের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প।
ইউজিসি-র নিয়মে বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যান্টি-র্যাগিং কমিটি রয়েছে নামেই। র্যাগিংবিরোধী আইন রয়েছে, কিন্তু তার কোনও ভূমিকা নেই। যদি থাকত তা হলে হয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখার এত বড় মাসুল দিতে হত না স্বপ্নদীপের মতো মেধাবী ছাত্রকে।
আজ চোখের জল ফেলে যে সমস্ত শিক্ষক স্বপ্নদীপের মৃত্যুর ন্যায়বিচার চাইছেন, তাদেরও আজ বুঝতে হবে, র্যাগিংয়ের মতো বীভৎস অন্যায় রুখতে অনেক আগেই তাঁদের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কঠিন হাতে নিষিদ্ধ করা দরকার ছিল র্যাগিংয়ের মতো দলবদ্ধ বিকৃত অপকর্মকে। তা হয়নি বলেই জীবন দিয়ে তার মাসুল দিয়ে গেল স্বপ্নদীপ। মাসুল দিতে হবে প্রতিটি মানুষকে, যদি তা প্রতিরোধ না করা যায়।
কী সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা? তা হল মানুষ তৈরির শিক্ষা। সুস্থ, উন্নত সংস্কৃতির চর্চা। এই কাজটাই করে চলেছে ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও। কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে অপসংস্কৃতি ও অপরাজনীতির পাল্টা স্রোত হিসাবে উন্নত নীতি-নৈতিকতার আধারে আন্দোলন গড়ে তুলেছে এবং ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকদের নিয়ে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা করে চলেছে যাদবপুর সহ নানা প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষাক্ষেত্রে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে আদর্শনিষ্ঠ, সঠিক পথে শক্তিশালী ছাত্র-আন্দোলন গড়ে তোলা এবং সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা ছাড়া বিকল্প পথ নেই।