করোনা অতিমারিতে মানুষের জীবন-জীবিকা চূড়ান্ত সঙ্কটের সম্মুখীন। সংকটকে গভীরতর করে তুলেছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন আর্থিক নীতি, যার অন্যতম রেল বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত।
২০১৯-এর ডিসেম্বরে রেলের ১০৯টি রুটের ১৫১টি ট্রেন বেসরকারি অপারেটরদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। এই ট্রেনগুলির টিকিটের দাম থেকে ক্যাটারিং-এর খাবারের দাম– সবই ঠিক করবে বেসরকারি কোম্পানি। তেজস এ’প্রেস বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। হামসফর ইত্যাদি নামের ট্রেনগুলিও বিক্রি হওয়ার অপেক্ষায়। যদিও ট্রেনগুলিতে চালক ও গার্ড জোগান দেবে ভারতীয় রেল। সংশ্লিষ্ট রুটের বাতানুকুল বাস বা বিমানভাড়ার সাথে সঙ্গতি রেখে ট্রেনের ভাড়া নির্ধারিত হবে বলে জানানো হয়েছে। এমনকি বিমানবন্দরের মতো স্টেশনেও ইউজার ফি বা ব্যবহারের খরচ হিসেবে বাড়তি অর্থ দিতে হবে যাত্রীদের। অর্থাৎ ট্রেনের ভাড়াযেমন বিপুল পরিমাণে বাড়বে তেমনি স্টেশনে পা দেওয়ার দণ্ড হিসাবে যাত্রীদের প্রচুর অর্থ খরচ করতে হবে।
সরকারের মাথাব্যথা অবশ্য সাধারণ মানুষকে নিয়ে নয়। তারা চিন্তিত বেসরকারি মালিকের মুনাফা নিয়ে। তাদের চিন্তা, লাভের মুখ না দেখলে বেসরকারি সংস্থাগুলি বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না। রেলের কোচ-কামরা ব্যবহার ও বিদ্যুতের খরচ মেটানোর পর যাতে বেসরকারি সংস্থাগুলির় ভাল অঙ্কের লাভ থাকে, সে বিষয়ে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ বলে জানিয়েছে রেল। এমনকি দূরপাল্লার ট্রেনে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তরা যে ছাড় পেতেন, তাও তুলে দেওয়া হচ্ছে। থাকছে না দূরপাল্লার যাত্রায় ছাড়ের বিভিন্ন সুযোগ। যাত্রাকালীন পরিষেবার জন্যও টিকিটের সাথে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হবে। যদিও রেলের কোচ, গার্ড-ড্রাইভার, স্টাফ, লাইন ইত্যাদি ব্যবহারের জন্য যে চার্জ সংস্থাগুলির দেওয়ার কথা, রেল প্রথম ৩৫ বছরে তাতে বিপুল ছাড়ের ব্যবস্থা রাখছে। অর্থাৎ জনগণের টাকায় গড়ে ওঠা রেলব্যবস্থাকে ব্যবহার করে পুঁজিমালিকরা লাভ করবে। একই সাথে লাভের অজুহাতে জনগণের ঘাড়ে নতুন করে কোপ বসানো হবে।
কোটি কোটি মানুষের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে ওঠা রেল ব্যবস্থা, যার পরিকাঠামো উন্নয়ন, কর্মচারীদের মাইনে, উৎপাদন সমস্ত কিছুই গড়ে উঠেছে জনগণের টাকায়, সেই রেল ব্যবস্থাকে বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিয়ে কার স্বার্থ সরকার রক্ষা করতে চাইছে– তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। বেসরকারি ব্যবস্থায় কোনও সুফল যে সাধারণ মানুষ পাবে না, ৫/৭/১০ হাজার টাকার টিকিট কেটে সাধারণ মানুষ যে ওইসব ট্রেনে যাতায়াত করবে না, তা বোঝা কঠিন নয়। বিপরীতে এই নীতিতে যেমন লক্ষ লক্ষ কর্মচারী কাজ হারাবেন, বন্ধ হবে নিয়োগ, কোটি কোটি হকার ও ঠিকা কাজে যুক্ত মানুষ কাজ হারিয়ে সর্বস্বান্ত হবেন, তেমনি যাতায়াত ও পরিষেবার কোনও সুযোগ সাধারণ মানুষ পাবেন না।
আশার কথা, এই সিদ্ধান্ত মানুষ মেনে নেয়নি। ইতিমধ্যেই হাজার হাজার মানুষ, রেল-কর্মচারী, উচ্ছেদের খাঁড়ার উপর দাঁড়িয়ে থাকা হকাররা এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন রেলস্টেশনে বিক্ষোভের পাশাপাশি প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে গণকমিটি। এই কমিটিগুলির নেতৃত্বে দলমতনির্বিশেষে সকল মানুষের সংগঠিত গণপ্রতিরোধই পারে সরকারকে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে বাধ্য করতে।