রেলকর্মীদের বেতন ও পেনশনের ভাঁড়ারে টান পডেছে, বিক্রি হতে যাচ্ছে রেলের ৪ লক্ষ ৩২ হাজার হেক্টর জমি৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের কথা বুক ফুলিয়ে প্রচার করছেন৷ এ কেমন আত্মনির্ভরতা একটু বিচার করা দরকার৷
ভারতীয় রেল পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম এবং ভারতের সর্ববৃহৎ সরকারি নেটওয়ার্ক৷ এই রেলের আছে ৪ লক্ষ ৩২ হাজার হেক্টর জমি, আছে ১ লক্ষ ৩০ হাজার কিলোমিটার রেলপথ, ৪৫ হাজার রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, কয়েক হাজার রেলওয়ে স্টেশন৷ প্রতিদিন প্রায় আডাই হাজার ট্রেন চলাচল করে৷ রেলওয়েতে বর্তমানে ১২ লক্ষের কিছু বেশি শ্রমিক কর্মচারী কাজ করেন৷ এক সময় এই সংখ্যা ছিল প্রায় সাডে ২২ লাখ৷ রেলের আছে নিজস্ব টেলিফোন ব্যবস্থা, সুরক্ষা ব্যবস্থা৷ ছিল নিজস্ব রেলওয়ে বাজেট৷ এর বেশিরভাগ যন্ত্রাংশ, কোচ, ওয়াগন, ইঞ্জিন, চাকা রেল নিজেই তার কারখানায় তৈরি করত৷ প্রায় প্রতিটি জোনেই এক বা একাধিক ছাপাখানা ছিল৷ প্রতিটি ডিভিশনে প্রায় সুপার স্পেশালিটি লেভেলের একটি করে হাসপাতাল আছে৷ প্রতিটি জোনে একটি করে অত্যাধুনিক বিশাল হাসপাতাল আছে৷ সমস্ত বড় রেল শহরগুলিতে প্রতি আড়াই কিলোমিটারে একটি করে হেলথ ইউনিট অর্থাৎ প্রাইমারি হেলথ সেন্টার আছে৷ প্রায় প্রতিটি জায়গায় রেলের বিভিন্ন ভাষাভাষী শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য নিজস্ব স্কুল ছিল৷ একসময় রেলকর্মচারীদের বিনা পয়সায় রেশন দেওয়ার জন্য ছিল নিজস্ব পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম৷ এরপরেও রেলওয়ে ভারতীয় কোষাগারে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে এসেছে৷ গত অর্থবছরে লাভ হয়েছে ৬ হাজার ৪০০ কোটি। এককথায় রেলওয়েকে বলা হত ‘A State within the State’৷
এহেন আত্মনির্ভরশীল ভারতকে মোদি সরকার কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে জুলাই মাসের ১৬ তারিখে এক সার্কুলারে জানানো হয়েছে যে রেলের বেশ কিছু পরিমাণ জমি বিক্রি করে ৩০ হাজার কোটি টাকা আয় করা যাবে৷ সেই বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ রেলওয়ে কলোনি বিক্রি করার কথা শুরু হয়ে গেছে৷ ১০৯টি রুটে ১৫১টি বেসরকারি ট্রেন চালানোর জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে৷ বিভিন্ন জোনের জেনারেল ম্যানেজারের কাছে নির্দেশ গেছে যাতে এই বেসরকারি ড্রেনগুলি চলাচলের ক্ষেত্রে কোনও বাধা সৃষ্টি না হয় তার জন্য সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে এবং তার সমস্ত রকম সুযোগ–সুবিধা সরকারি রেলওয়েকেই করে দিতে হবে৷ এই বেসরকারি ড্রেনগুলির ১৫ মিনিট আগে বা ১৫ মিনিট পরে ওই রুটে কোনও ড্রেন চলাচল করতে পারবে না৷ রেলের জমি, পরিকাঠামো, কর্মী ইত্যাদি সবকিছু ব্যবহার করে ব্যক্তিমালিকরা যে ড্রেন চালাবে তার লাভ যাতে নিশ্চিত হয় তাও সরকারি রেলওয়ে ব্যবস্থাকেই করে দিতে হবে৷ পডে পডে মার খাবে সরকারি রেল৷
এখন শোনা যাচ্ছে রেল কর্মচারীদের বেতন ও পেনশন দেওয়ার টাকার ভাঁডারে টান পডেছে৷ রেল কর্মচারী এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা শঙ্কিত৷ একসময় যখন রেলের নিজস্ব বাজেট ছিল, যখন রেলের ক্রমাগত বিস্তার ঘটেছে, নতুন নতুন রেললাইন পাতা হয়েছে, ভারতবর্ষের সমস্ত দুর্গম স্থানে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে৷ তখন লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক–যুবতীদের রেলে কর্মসংস্থান হয়েছে , বিনা পয়সায় ত্রাণসামগ্রী পরিবহণ হয়েছে, স্বল্প ভাডায় খাদ্যসামগ্রী পরিবহণ হয়েছে, দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ণে সামরিক পরিবহণ হয়েছে, তখন তো এই অবস্থার সৃষ্টি হয়নি৷ প্রতি বছর রেল তার নিজস্ব বাজেট থেকে সাধারণ বাজেটে হাজার হাজার কোটি টাকা লভ্যাংশ দিয়ে এসেছে৷
আজ মোদীর আত্মনির্ভর ভারতবর্ষে সত্যি সত্যি যদি রেল লোকসানে এসে দাঁড়ায়, তার জন্য মোদি সরকারকেই তো দায় নিতে হবে৷ মালিক তোষণকারী জনবিরোধী নীতি পরিবর্তন করতে হবে৷ কেন্দ্র সরকারের এই জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদে ৩১ জুলাই ভারতের একমাত্র বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন এ আই ইউ টি ইউ সি–র পক্ষ থেকে সারা ভারত রেল বাঁচাও দিবস পালিত হয়৷ রেলের নানা জোনের বহু ডিভিশনে রেল কর্মচারীরা এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশা নেন৷