বাহানাগা বাজার স্টেশনে করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় তিনশো যাত্রীর মৃত্যুর দুঃসহ স্মৃতি মুছতে না মুছতেই শিলিগুড়ির কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা জনমানসে গভীর বেদনার সঞ্চার করেছে। ইতিমধ্যে আরও কিছু রেল দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, যা বিশেষ প্রচার পায়নি। রেলমন্ত্রক যথারীতি দুর্ঘটনায় মৃত মালগাড়ির চালকের ওপর দুর্ঘটনার সমস্ত দায় চাপিয়ে অব্যাহতি পেতে চাইছে। করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাতেও রেলমন্ত্রী সহ রেলমন্ত্রকের কর্তাব্যক্তিরা একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন।
উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলা যেতে পারে। তাতে দায়িত্ব অস্বীকার করা হয়। কিন্তু মূল সমস্যাগুলি চাপা পড়ে যায়। ফলে একই জিনিস বারবার ঘটে। সাধারণ মানুষের প্রাণ যায়। নেতা-মন্ত্রীদের কুম্ভীরাশ্রু রেলযাত্রা নিরাপদ করতে পারে না। তাই গত তিন বছরে ২০টির-ও বেশি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রাণ গেছে রেলকর্মী সহ অসংখ্য সাধারণ মানুষের। নেতা মন্ত্রীরা দায়িত্বশীল হলে সমস্যার গভীরে ঢোকার চেষ্টা করতেন। তার সমাধান করার চেষ্টা করতেন। তা না করে ড্রাইভারের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে পার পেতে চাইছেন। কিন্তু মালগাড়ির আহত সহকারী চালকের বয়ান তাঁদের পর্দা ফাঁস করে দিয়েছে। খবরে প্রকাশ, পরপর চারদিন নাইট ডিউটি করার পর পঞ্চম দিনে চালককে ঘুম থেকে তুলে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এ ঘটনা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। গোটা রেল দপ্তরে চলছে অসহনীয় অরাজকতা। প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নেতা, মন্ত্রীরা ফুলে ফেঁপে উঠছেন। বাস্তবে কী ঘটছে? রেলে ব্যাপক কর্মী সংকোচন হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে যেখানে রেলে সাড়ে বাইশ লাখ শ্রমিক কাজ করতেন, আজ সেখানে কর্মীসংখ্যা দশ লাখের কাছাকাছি। অথচ ১৯৭৪ সালের পরে রেলের যাত্রী পরিবহণ, মাল পরিবহণ, ট্রেন, মালগাড়ি ও স্টেশনের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। সেফটি ক্যাটিগরিতেও ব্যাপক কর্মী সংকোচন হচ্ছে। গার্ড, ড্রাইভার, স্টেশন মাস্টার, গ্যাংম্যান, সিগন্যাল স্টাফ, ওভারহেড তার মেরামত করার কর্মী, টিকিট পরীক্ষক সহ এমার্জেন্সি স্টাফদের ওপর ব্যাপক চাপ বাড়ছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ কোনও ছুটি পাওয়া যাচ্ছে না। কাজের সময়ের কোনও সীমা থাকছে না। প্রতিবাদ করলেই চার্জশিট, সাসপেনশন, রিমুভ্যাল, ডিসমিস্যাল অর্থাৎ ছাঁটাই।
রেলে এক মধ্যযুগীয় আইন আছে– ১৪/২, যাতে কোনও তদন্ত ছাড়াই যে কোনও রেলকর্মীকে ডিসমিস করে দেওয়া যায়। এই আইনবলে তাঁকে সারা জীবনের জন্য সমস্ত রকম চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যায়। বছরকয়েক আগে খড়গপুর ডিভিশনে শুধু মাত্র ছুটি না পাওয়ার কারণে এক ড্রাইভার আত্মহত্যা করেন। তার প্রতিবাদ করার জন্য আটজন ড্রাইভারকে ১৪ঙ্গ২ ধারায় অভিযুক্ত করে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। কাজের চাপজনিত কারণে গত ১৫ জুন গোয়ালিয়র স্টেশনে একজন প্রধান টিকিট পরীক্ষক সহ দুজন টিকিট পরীক্ষক চলন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন। কয়েক মাস আগে সেন্ট্রাল রেলে কয়েক জন কর্মী বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন। ওয়ার্কশপগুলোতে যে পরিমাণ কর্মী দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হচ্ছেন বা মারা যাচ্ছেন তাদের খবর কেউ রাখে না। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বেসরকারিকরণের নজিরবিহীন আক্রমণ। যেসব রেল ইঞ্জিন, কোচ ওয়াগন, যন্ত্রাংশ রেলের নিজস্ব কারখানায় তৈরি হত, যেখানে গুণমান নিয়ে কোনও সমঝোতা করা হত না, সেগুলি আজ বাইরের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি ইলেকট্রিসিটি মার্কেটিং পোর্টাল (জেম)-এর মাধ্যমে কেনা হচ্ছে। চলছে কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যাপক কাটমানির কারবার। রেলের নিজস্ব ইন্সপেকশন ব্যবস্থাকে ঠুঁটো করে রেখে দেওয়া হয়েছে। মেরামতির সব কাজ বেসরকারি মালিকদের দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কম পারিশ্রমিকে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে ঠিকাদাররা সেই কাজ করিয়ে নিচ্ছে। তাতে একদিকে চলছে নির্মম শ্রমিক শোষণ। অপরদিকে গুণগত মান নিচে নেমে যাচ্ছে। মালগাড়িগুলির ওয়াগন এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেসরকারি। সেখানে মুনাফার লোভে রেললাইনের সহনসীমার অতিরিক্ত মাল পরিবহণ করে রেলপথকে বিপজ্জনক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। একই ট্রেনকে রক্ষণাবেক্ষণের সুযোগ না দিয়ে বিভিন্ন রুটে চালানো হচ্ছে। এ রকম বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। এ সবই ঘটছে রেলের কর্তাব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। রেল শ্রমিকরা প্রতিবাদ করলে শাস্তির খাঁড়া নেমে আসছে।
রেলযাত্রায় সুরক্ষা ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত করতে অ্যান্টি কলিশন ডিভাইসের কথা শোনা গেছে বিজেপি ক্ষমতায় আসার বহু আগেই। বিজেপি সরকার এসে ঘটা করে তার নাম দিয়েছে ‘কবচ’। কিন্তু তার জন্য টাকা বরাদ্দ এতই কম যে ১০ বছরে অতি সামান্য রেলপথেই তা বসেছে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অন্যান্য আধুনিক সুরক্ষা ব্যবস্থার হালও তাই।
রেলের আধুনিকীকরণ মানে যে স্টেশনে শপিং মল তৈরি আর বন্দে ভারত চালানো নয়, বিজেপি সরকার সেই সরল সত্যটা আদৌ বোঝে কি না সন্দেহ। রেল তাদের কাছে মুনাফার হাতিয়ার মাত্র। জনমুখী দৃষ্টি তথা যাত্রীস্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়ার বদলে মুনাফার দৃষ্টিভঙ্গিতে রেলকে দেখার ফলেই রেলের সামগ্রিক পরিকাঠামো তৈরি এবং পরিচালনায় চূড়ান্ত সমন্বয়ের ঘাটতি হচ্ছে। যার মাশুল দিতে হচ্ছে যাত্রী ও নিচুতলার রেল কর্মীদের।