দেশ জুড়ে প্রায় এক কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন রেলে হকারি করে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রেল হকারের সংখ্যা প্রায় দশ লাখ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ট্রেনের এক বগি থেকে অন্য বগিতে দৌড়ঝাঁপ করে বেঁচে থাকার লড়াইতে টিকে থাকতে হয় তাঁদের। করোনা অতিমারিতে ট্রেন বন্ধ থাকায় ভয়ঙ্কর দারিদ্রের রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রেলের একটা ছোট্ট বিজ্ঞপ্তিতে এই হকারদের জীবনে নেমে এসেছে গভীর অন্ধকার। পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এখন থেকে রেলে কাউকে হকারি করতে দেওয়া যাবে না।
কোনও পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই কি রেলের এই বিজ্ঞপ্তি? এটা কি কোনও বিছিন্ন ঘটনা? একেবারেই না। আসলে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ ও বেসরকারিকরণের জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে ভাবে উঠে-পড়ে লেগেছে, তারই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে ভারতীয় রেল। ইতিমধ্যেই আধুনিকীকরণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দোহাই দিয়ে বেশ কিছু রেল স্টেশন ও প্ল্যাটফর্ম বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। রেলের অব্যবহৃত জমি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে স্বল্পমূল্যে লিজে দেওয়া হচ্ছে দীর্ঘ বছরের জন্য। ১৫০টি ট্রেনকে বেসরকারি পর্যটন সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং সেই মতো গত বছরের জুন মাসে দেশের প্রথম বেসরকারি ট্রেন চালু হয়েছে কোয়েম্বাটুর়ে। এই বছরের আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘটা করে ঘোষণা করেছেন ‘অমৃত ভারত স্টেশন’ প্রকল্পের। এর অধীনে দেশজুড়ে ৫০৮টি স্টেশনের খোলনলচে বদলে ফেলা হবে, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ৩৭টি স্টেশনও আছে। এইসব স্টেশনে থাকবে এস্কালেটর, বাতানুকূল ওয়েটিং রুম, পার্কিংয়ের ব্যবস্থা এবং বিনামূল্যে ৫ জি ওয়াইফাই পরিষেবা। যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য থাকবে কফিশপ, রেস্তোরাঁ থেকে বিভিন্ন দামী ব্র্যান্ডের পোশাকের দোকান যার সাথে দেশের গরিব খেটে খাওয়া সাধারণ যাত্রীদের কোনও সম্পর্কই নেই। বোঝাই যায়, আগামী দিনে ধীরে ধীরে এই সব স্টেশন তুলে দেওয়া হবে বেসরকারি সংস্থার হাতে, মুনাফা লোটার জন্য। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়বে প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম, ওয়েটিং রুমের জন্যও দিতে হবে চড়া চার্জ, বাড়বে নিত্যযাত্রীদের রেল ভাড়া।
কিন্তু এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে দিন আনা-দিন খাওয়া রেল হকাররা যে বড়ই বেমানান! তাই কর্তৃপক্ষ অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দিয়েছে রেলে আর হকারি করা যাবে না। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বদান্যতায় তাই অচিরেই একদিকে আলোয় আলোয় ঝলমল করবে স্টেশনগুলো, অন্যদিকে গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যাবে গরিব হকারদের জীবন। অসুবিধায় পড়বেন সাধারণ নিত্যযাত্রীরাও।
বর্তমানে হকারদের উপর আরপিএফের অত্যাচার ক্রমে বেড়েই চলেছে। কেস দেওয়া, জরিমানা করা, ভয় দেখিয়ে তোলাবাজি এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। শুধু তাই নয়, হকারদের শারীরিক নিগ্রহ, মালপত্র ফেলে দেওয়া, দোকান ভেঙে দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ আছে আরপিএফের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদে হকাররা বেশ কয়েক বার বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, রেল অবরোধ করেছেন। কিছুদিন আগে হুগলির কোন্নগর স্টেশনের দোকানদারদের বলা হয়় জমি জরিপের জন্য দু’দিনের জন্য দোকান সরিয়ে নিতে। দু’দিন পর জমি জরিপের কাজ শেষ হলে দোকানদাররা যখন স্টেশনে আবার দোকান বসাতে যান, বাধা দেওয়া হয় রেলের তরফে। এই দোকানদারেরা ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্টেশনে ব্যবসা করছেন। জীবিকায় বাধা পেয়ে নিরুপায় হকাররা একরকম জোর করেই দোকান বসান ওই স্টেশনে। রাতের অন্ধকারে রেল ওই দোকানগুলো পুনরায় ফেলে দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন হকাররা। প্রতিবাদ জানালে স্টেশন কর্তৃপক্ষ বলে ডিআরএমের নির্দেশে এই কাজ করা হয়েছে। এরপর গত ১৬ সেপ্টেম্বর হকারেরা জোট বেঁধে হাওড়া ডিভিশনের ডিআরএমের সাথে দেখা করতে রওনা হন। ট্রেন স্টেশনে পৌঁছালে কার্যত বিনা প্ররোচনায় শতাধিক সিআরপিএফ লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে হকারদের উপর। এই বর্বরোচিত আক্রমণে বেশ কয়েকজন হকারের মাথা ফাটে, অনেকেই গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সাধারণ যাত্রী থেকে চিত্র সাংবাদিক কেউই সেদিন রক্ষা পাননি। দুই যাত্রী সমেত ২৫ জন হকারকে গ্রেপ্তার করে আরপিএফ। সহায়-সম্বলহীন নিরপরাধ হকারদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করতে রেল কর্তৃপক্ষ যেভাবে পুলিশ লেলিয়ে দিল, যে বর্বরোচিত আক্রমণ চালালো হকারদের উপর, তার নিন্দায় কোনও ভাষাই যথেষ্ট নয়। শ্রমিক সংগঠন এআইইউটিইউসি এর তীব্র নিন্দা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাবি করেন, তিনি নাকি একদা স্টেশনে চা বিক্রি করতেন। অথচ রেল হকারদের প্রতি সামান্য সহানুভূতি দূরের কথা, তাঁদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকুও কেড়ে নিতে চাইছে তাঁর সরকার। আসলে একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থবাহী এই সরকার যেখানে যতটুকু মুনাফা অর্জনের সুযোগ আছে, তা তুলে দিতে চায় বৃহৎ পুঁজির হাতে। তাই আইআরসিটিসি সহ অন্যান্য বেসরকারি সংস্থাকে রেল-ব্যবসায় জায়গা করে দিতেই তাদের এই হকার উচ্ছেদের ফতোয়া।
ক্ষমতায় আসার আগে বেকারত্ব দূর করার যে সব বড় বড় প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দলবল দিয়েছিলেন, গত কয়েক বছরে সে সব কার্যত জুমলায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন বেড়ে চলেছে বেকারত্বের হাহাকার। রেল সহ অন্য কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থায় হাজার হাজার শূন্যপদে নিয়োগ বন্ধ। একের পর এক কলকারখানায় চলছে লে-অফ, কর্মী ছাঁটাই। এই পরিস্থিতিতে দেশের সরকার যখন নতুন কাজের সুযোগ তৈরিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তখন এই অমানবিক রেল-হকার উচ্ছেদ শুধু হকারদের জীবনকেই দুর্বিষহ করে তুলবে তাই নয়, সমাজ জীবনেও গভীর অস্থিরতা তৈরি করবে। ফলে অবিলম্বে রেল হকার উচ্ছেদের বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার এবং তাঁদের দ্রুত ‘হকার আইন ২০১৪’-র অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে সঠিক নেতৃত্বে গড়ে তুলতে হবে ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী হকার আন্দোলন।