বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় রেলের পূর্ণ বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে ১১৯টি ট্রেন চালানোর জন্য টেন্ডার আহ্বান করেছে৷ এ ছাডা আরও প্রায় ৩২টি বেসরকারি ট্রেন চালানোর কথা ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়ে গেছে৷ এই ট্রেনগুলি অত্যন্ত দ্রুত গতি সম্পন্ন হবে এবং যেসব স্টেশন থেকে ট্রেন গুলি ছাড়বে তার ১৫ মিনিট আগে বা পরে এই রুটের অন্য কোনও ট্রেন ছাড়বে না৷ জনগণের সম্পত্তি রেলের লাইন, স্টেশন সিগন্যাল ব্যবস্থা, গার্ড, ড্রাইভার, ব্যবহার করে বেসরকারি মালিকরা কোটি কোটি টাকা মুনাফা করবে৷ অন্য দিকে সিনিয়ার সিটিজেন, প্রতিবন্ধী, ছাত্র এবং বিশেষ ধরনের রোগীদের কনসেশন ইত্যাদি যতটুকু সুযোগ সুবিধা জনগণ পেত, সবই বন্ধ হয়ে যাবে৷ ইতিমধ্যেই অলাভজনক আখ্যা দিয়ে প্রত্যন্ত এবং দুর্গম এলাকার বেশ কয়েকটি রেল রুট বন্ধ করে দিয়েছে সরকার৷ অথচ এই রেলপথই প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের যোগাযোগ এবং জীবিকার প্রয়োজনে যাতায়াতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম৷
ভারতীয় রেল পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম নেটওয়ার্ক এই ব্যবস্থায় রয়েছে ১ লক্ষ ২৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথ, ৪৫ টি রেলওয়ে ওয়ার্কসপ, হাজার হাজার রেলওয়ে স্টেশন ,লক্ষ লক্ষ একর জমি এবং স্থায়ী ১২ লক্ষ কর্মচারী যা একসময় ছিল সাড়ে বাইশ লাখের কাছাকাছি৷ এছাডাও ঠিকাদারদের অধীনে লক্ষ লক্ষ কর্মচারী কাজ করে৷ রেল হলো একটি অত্যাবশ্যকীয় পাবলিক ইউটিলিটি সার্ভিস৷ শুধুমাত্র লাভের উদ্দেশ্যে তাকে পরিচালনা করা চলে না৷ তা স্বত্ত্বেও ভারতীয় রেল একটি অত্যন্ত লাভজনক সংস্থা৷ গত ২০১৯–২০ অর্থবর্ষে সরকারি হিসেবেই রেলের লাভ হয়েছে ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা৷ সারাদেশে ধমনীর মতো ছডিয়ে পড়া এই রেল শিল্প হল দেশের অন্যতম লাইফ লাইন৷ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সেই রেলকে বেসরকারি মালিকের হাতে তুলে দিতে চাইছে৷
রেলের এই বেসরকারীকরণের শুরু হয় কংগ্রেস আমলেই৷ ১৯৯১ সালে কংগ্রেস সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং নয়া আর্থিক নীতি ঘোষণা করেন তারপরেই রেলের বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে প্রকাশ ট্যান্ডন কমিটি গঠন করা হয়৷ যা রেলকে ধাপে ধাপে বেসরকারিকরণের প্রথম ব্লু–প্রিন্ট৷ তার সুপারিশ অনুযায়ী রেলের নিজস্ব ক্যাটারিং ব্যবস্থাকে আইআরসিটিসিতে রূপান্তরিত করা হয়৷ মাল পরিবহনের জন্য গঠন করা হয় কন্টেনার করপোরেশন৷ রেলের বহু অফিস সাফাই ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজ তখন থেকেই বেসরকারি হাতে চলে যায়৷ পদ বিলুপ্তি করা, ক্যাজুয়াল কর্মী নিয়োগ বন্ধ, এসবই প্রায় তখন থেকেই শুরু হয়ে যায়৷
২০০২ সালে গঠিত হয় রাকেশ মোহন কমিটি৷ এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রেলওয়ে ব্যবস্থাকে কোর, অর্থাৎ যে অংশ সরাসরি রেল পরিবহনের সাথে যুক্ত তা বাদ দিয়ে বাকি রেলওয়ে ব্যবস্থাকে ননকোর আখ্যা দিয়ে তার সামগ্রিক বেসরকারিকরণ শুরু হয়ে যায়৷ রেলের বহু স্কুল, হাসপাতাল, নিজস্ব ছাপাখানা, অফিস, কারখানা, পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয় নতুবা আউটসোর্স করে দেওয়া হয়৷ রেলের সাতটি প্রোডাকশন ইউনিট যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস আছে তাদেরকে করপোরেটাইজ করে ধীরে ধীরে ব্যক্তি মালিকের কাছে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা তখন থেকেই শুরু করা হয়৷ ২০১৫ সালে বিজেপি সরকারের নেতৃত্বে গঠিত হয় বিবেক দেবরায় কমিটি৷ এই কমিটি রেলের সামগ্রিক বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে একগুচ্ছ পরিকল্পনা পেশ করে৷ শক্তিশালী ড্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অনুপস্থিতিতে মোদি সরকার একের পর এক সেই পরিকল্পনাই রূপায়িত করে চলেছে৷
ইতিমধ্যে প্রায় সমস্ত স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ সমস্ত ছাপাখানা প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ যে পাঁচটি ছাপাখানা অবশিষ্ট আছে তাও বন্ধ করে দেওয়ার অধ্যাদেশ জারি করা হয়ে গেছে৷ রেলের ১৭টি জোনের ১৭টি জেনারেল স্টোর ডিপো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে৷ এর সাথেই যুক্ত হয়েছে বেসরকারি ট্রেন চালানোর প্রক্রিয়া৷ ইতিমধ্যে বেসরকারি তেজস ট্রেন চালু হয়ে গেছে৷ এবং আরো ১৫১টি বেসরকারি ট্রেন চালানোর প্রক্রিয়া চলছে৷ শহরতলিতে ও বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ রুটে বেসরকারি ট্রেন চলাচলের পরিকল্পনা হয়ে গেছে৷
রেলের বেসরকারিকরণ জনজীবনে মারাত্মক দুর্দশা ডেকে আনবে৷ ট্রেনের ভাড়া বাড়বে ব্যাপকহারে৷ এখনই ডায়নামিক ফেয়ারের নামে রেল কর্তৃপক্ষ কার্যত কালোবাজারিদের মতো চাহিদা বাড়লেই যথেচ্ছ ভাড়া আদায় করে যাত্রীদের লুঠ করছে৷ এই প্রবণতা আরও বাড়বে৷ যতটুকু জনকল্যাণমূলক কাজ আজও রেল করে তার সবটাই উঠে যাবে৷ ইতিমধ্যে অলাভজনক বলে ৩৪টি ট্রেন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে৷ যার ফলে কম খরচে যাতায়াত করার জেনারেল কামরা প্রায় উঠে যাবে৷ মানুষ বাধ্য হবে দামি ট্রেনে বা দামি কামরায় চড়তে৷ ছোটখাটো স্টেশন এলাকায় ছোট ব্যবসায়ীদের পণ্য এবং কৃষি পণ্যের পরিবহণ ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে পড়বে৷ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে বিনা ভাড়ায় যে ত্রাণ সামগ্রী পরিবহন করা হত তা বন্ধ হয়ে যাবে৷ রেল কর্মীদের ফ্রি পাস, চিকিৎসার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে৷ অর্জিত বহু অধিকার চলে যাবে৷ দেশের বৃহত্তম নিয়োগকারী সরকারি সংস্থায় স্থায়ী নিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে৷ ইতিমধ্যে শূন্যপদের ৫০ শতাংশ বিলোপ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে৷ প্রতিবছর আরও বহু পদ বিলোপ করে দেওয়া হবে৷ ইতিমধ্যেই মালগাডির গার্ড, লেভেল ক্রসিংয়ের পাহারাদার, সহ রেল চলাচলের নিরাপত্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদ হয় বিলোপ করা হয়েছে, না হলে ঠিকাদারের হাতে চলে গেছে৷ কমেছে ড্রাইভার, মোটরম্যান, কেবিনম্যান, স্টেশনের ট্রাফিক সংক্রান্ত কর্মচারী নিয়োগ৷ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়ে সাধারণ মানুষকে তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে৷
৫৫ বছর বয়স ৩০ বছর চাকরি হয়েছে এমন অভিজ্ঞ রেল কর্মচারীদের রেল থেকে বসিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে৷ অথচ এঁরাই অভিজ্ঞতা দিয়ে বহু বিপদ সামলে দিয়ে থাকেন৷রেলের জমি ও রেল কলোনি বিক্রি করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে৷ এছাড়া এই ব্যবস্থার সাথে যুক্ত রয়েছেন অসংখ্য হকার ও দোকানদার তাদের জীবন ও অনিশ্চয়তায় নেমে আসবে তারা প্রায় কেউই রেল চত্বরে ব্যবসা করতে পারবে না তার জায়গা নেবে বড় বড় শপিং মল মাল্টি প্লাজা কমপ্লেক্স৷ ফলে কর্মহীন হবেন আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ৷ এইসব শপিং মল ফুড প্লাজা মাল্টি কমপ্লেক্স হবে ব্যয়বহুল৷ ফলে রেল ভ্রমণ আরো ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে৷ রেল বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের ফলে শ্রমজীবী মানুষ সহ সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসবে চরম সর্বনাশ৷
কেন এই বেসরকারিকরণ? এতে কি রেলের উন্নতি ঘটবে? সরকার তাই বলে৷ কিন্তু বেশি পিছনে যাওয়ার দরকার নেই৷ সাম্প্রতিক কোভিড মহামারি পরিস্থিতি কী শিক্ষা দিল? স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেসরকারিকরণের সময় সরকারগুলি এই উন্নয়নের যুক্তিই কি দেয়নি? আজ মহামারির সময় দেখা যাচ্ছে বেসরকারিকরণ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রায় শেষ করার দিকেই নিয়ে গেছে৷ রেল বেসরকারিকরণের ফলে বৃহৎ পুঁজিপতিরা এতে টাকা ঢেলে পাহাড়প্রমাণ মুনাফা করবে৷ কিন্তু দেশের পণ্য এবং যাত্রী পরিবহণের মূল সূত্রটাই তাদের হাতে চলে যাওয়ায় মার খাবে ছোট পুঁজি নিয়ে টিকে থাকার লডাইয়ে রত দোকানদার, খুচরো ব্যবসাদার, ছোট এবং মাঝারি কৃষক প্রভৃতি সাধারণ মানুষ৷ শুধু যাত্রী ভাড়া বাডবে তাই নয়, ধীরে ধীরে সড়ক এবং রেল দুই পরিবহণই চলে যাবে দৈত্যাকার বহুজাতিক পুঁজির হাতে৷ বিজেপি, কংগ্রেস যে সরকারই গদিতে থাকুক, তারা সকলেই এই একচেটিয়া মালিকদের সেবাদাস হিসাবেই কাজ করে৷ দেশের মানুষের কষ্টার্জিত টাকায় গডা রেলকে এজন্যই বেচে দেওয়ার ঠিকা নিয়েছে বিজেপি সরকার৷ নরেন্দ্র মোদী গত নির্বাচনের আগে বারাণসীতে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্বাস করুন রেলকে আমি কখনও বেসরকারি হাতে যেতে দেব না’৷ তিনি নাকি ‘হিন্দু কুল তিলক’৷ ধার্মিক হিন্দুরা গঙ্গা জল ছুঁয়ে আর বারাণসীতে দাঁড়িয়ে কখনও মিথ্যা বলেন না৷ মোদিজি কেমন হিন্দু, যে বারাণসীতে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষকে ধোঁকা দিলেন?
এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে, ১৯৭৪ সালের ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের শিক্ষাকে স্মরণে রেখে দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী এবং আপসহীন আন্দোলন গডে তুলতে হবে রেল শ্রমিকদের৷ শুধু রেল কর্মচারী নয়, দেশের অন্যান্য অংশের শ্রমজীবী মানুষকে এই প্রতিরোধ আন্দোলনে শামিল করে সরকারকে বাধ্য করতে হবে এই সর্বনাশা নীতি পরিবর্তনের জন্য৷