এবার পুজোর আরম্ভেই রাজ্যের তৃণমূল সরকার এক ‘ইতিহাস’ গড়েছে৷ তার আবগারি বিভাগ একমাসে ১১০০ কোটি টাকার রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা করেছে৷ আবগারির ইতিহাসে যা কখনওই ঘটেনি৷ তবে এমন একটি ইতিহাস সৃষ্টি একদিনে হয়নি৷ এর জন্য ধাপে ধাপে পরিকল্পিতভাবে এগোতে হয়েছে৷ পুজোর সময় মানুষ যখন আনন্দে মাতোয়ারা হয়, তখন যাতে কোনও অনিষ্ট বা দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য সরকারি নির্দেশে পুজোর দিনগুলোতে মদের দোকানগুলি বন্ধ রাখা হত৷ ২০১৬ সাল থেকে সরকারি নির্দেশে পুজোর চারদিনই দোকান খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়৷ পরের বছরই সরকার রাজ্যের অর্থদপ্তরের অধীনে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট বেভারেজ কর্পোরেশন লিমিটেড’ নামে একটা কোম্পানি খুলে রাজ্য জুড়ে মদের গোটা পাইকারি ব্যবসাটা হাতে তুলে নেয়৷ সেদিনই কোম্পানির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসাবে ঘোষণা করা হল–‘ইট স্ট্রাইভস টু আর্ন এনাফ ক্যাশ টু সাসটেন ইটস বিজনেস অ্যান্ড টু পে ডিভিডেন্ডস টু দ্য গভর্নমেন্ট’৷ অর্থাৎ, এই সরকারি কোম্পানির উদ্দেশ্য হল মদ বেচে প্রচুর টাকা কামিয়ে সরকারের হাতে তুলে দেওয়া৷ জেলায় জেলায় ৩৫টি দেশীয় মদের ডিপো এবং ২৩টি বিদেশি মদের ডিপো খোলা হয়৷ খুচরো বিক্রেতারা আগাম দাম দিয়ে এখানে মদ কেনে৷ আবগারি আইনকে শিথিল করে মদের ঢালাও লাইসেন্স দেওয়া এবং তার মাধ্যমে রাজস্বের আয় বাড়ানোর রাস্তাটি দেখিয়েছিল এ রাজ্যের সিপিএম ফ্রন্ট সরকার৷ তৃণমূল সরকার সেই পথেই হেঁটেছে এবং এই বছরের শুরুতে ঘোষণা করেছিল গ্রামে গ্রামে আরও ১২০০ নতুন দোকান খোলার অনুমতি দেওয়া হবে৷ যদিও জেলায় জেলায় মানুষের সক্রিয় প্রতিরোধে তারা আপাতত তা স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে৷
আর একটি বিষয়েও এ রাজ্যের সরকার ইতিপূর্বেই ইতিহাস তৈরি করেছে৷ নারী নির্যাতনের ঘটনায় এ রাজ্য প্রথম স্থানে৷ সকলেই জানেন এই বিষয় দু’টি পরস্পরের পরিপূরক৷ মদ্যপ ব্যক্তির স্বাভাবিক সুস্থ চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে না৷ কোনও অপরাধের গুরুত্ব বা তার পরিণতি কী হতে পারে–সেটা বিচার করার অবস্থায় সে তখন থাকে না৷ ফলে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মদ্যপদের আসর যত জমজমাট হতে থাকে, মহিলাদের স্বচ্ছন্দ চলাফেরায় ততই ঝুঁকি বাড়তে থাকে, টিউশন পড়ে কিংবা কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মহিলাদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে৷ পুজোর জাঁকজমক ও আড়ম্বরে সরকার যারপরনাই মদত দিয়ে চলেছে৷ চাইছে মানুষ উৎসবের হই–হুল্লোড়ে মেতে থাকুক৷ শারদোৎসব উপলক্ষে যে অনাবিল আনন্দের পরিবেশ বাংলার বহুদিনের ঐতিহ্য– এই হুল্লোড় তার ক্ষতি করছে৷ উৎসবের ভিড়ে মদ্যপদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকে কি? নাকি শুধু সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? যদি কোনও সরকারের সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে, তবে সে সরকার সমাজের রুচি–সংসৃক্তির পরিবেশকে কলুষিত করার জন্য দায়ী মদের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে পারে না– রাজস্ব বৃদ্ধির নীতি হিসাবেও নয়৷ বরং মদ নিষিদ্ধ করে সমাজে সুস্থ সামাজিক পরিবেশকে সুনিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর হওয়া উচিত৷