সদ্য শেষ হওয়া লোকসভা নির্বাচনে মানুষ মূলত বিজেপি বিরোধী ভোট দিয়েছে। আশা করেছে, দেশের একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের স্বার্থে বিজেপি যেভাবে সাধারণ মানুষের উপর শোষণের স্টিম রোলার নির্মম ভাবে চালিয়েছে তার অবসান ঘটবে। একই সাথে বিজেপির সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অবসান চেয়েছে মানুষ। কিন্তু ভোটের পর সংসদের প্রথম অধিবেশন কি মানুষের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণে এতটুকুও আশা জাগালো? বিজেপির বিরোধিতা করতে গিয়ে বিরোধী পক্ষ কি তার একেবারে বিপরীত কোনও রাজনীতির সন্ধান মানুষকে দেওয়ার চেষ্টা করল? দেখা গেল একেবারেই তা নয়। কংগ্রেস নেতা তথা বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী শিবের ছবি দেখিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন হিন্দু দেবতা শিব হিংস্র নন, কিন্তু রামের শিষ্য বিজেপি হিংস্র।
রাহুল গান্ধী বিজেপির উগ্র, হিংস্র সাম্প্রদায়িক রূপটিকে তুলে ধরতে চাইলেন ঠিকই– কিন্তু তিনি কি তার মধ্য দিয়ে কোনও বিকল্প রাজনৈতিক পথের সন্ধান দিলেন? শিবের পাশাপাশি তিনি মুসলিমদের নমাজ পড়া হাতের ছবি সহ নানা ধর্মের প্রবর্তকদের ছবি দেখিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন তাঁদের হাতের মুদ্রার সঙ্গে কংগ্রেসের ভোট চিহ্নের প্রচুর মিল আছে। অর্থাৎ বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কটাক্ষ করতে গিয়ে রাহুল গান্ধীর দল কংগ্রেস যে কৌশলের আশ্রয় নিল তার আর এক নাম হল নরম সাম্প্রদায়িকতা। তারা বিজেপিকে ভোটে পরাস্ত করতে চেয়েছে, তার জন্য বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসাতে তাদের থেকে বড় হিন্দু সাজতে চেয়েছে। একই সাথে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের ভোট পাওয়ার জন্য তাদের ধর্মীয় চিহ্নকেও তুলে ধরেছে। কিন্তু বিজেপির অনুসৃত রাজনীতিকে পরাস্ত করার কথা ভাবেনি। বিজেপির মতোই তাঁরাও এ দেশের বিরাট সংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজ করা ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে চেয়েছেন। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের প্রচার পর্বের অধিকাংশটা জুড়ে বিজেপি বিশেষত নরেন্দ্র মোদি হিন্দু-মুসলমান, মঙ্গলসূত্র ইত্যাদি নিয়ে পড়ে ছিলেন। কংগ্রেস নেতারা এর পাল্টা হিসাবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা কিছু কিছু তুলে ধরলেও তাঁরা কোন কোন মন্দিরে ঘুরছেন, তার ছবিও যাতে প্রচারিত হয় সে দিকে লক্ষ রেখেছিলেন। বাস্তবিকই যে কোনও ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের কাছে মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো যেমন প্রচারের একটা হাতিয়ার, তেমনই একই সাথে নরম হিন্দুত্ব তথা জাতপাত ও কৌশলী সাম্প্রদায়িক প্রচারও তাঁদের অন্যতম হাতিয়ার। যে কারণে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজেপি যখন তীব্র বিষোদগার করে কংগ্রেস সরাসরি তার বিরোধিতা করে না, পাছে তাদের হিন্দু ভোটব্যাঙ্কে টান পড়ে! ভোটের জন্যই কংগ্রেস অতীতে সাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগাতে এমনকি দাঙ্গা বাধাতেও পিছপা ছিল না। এখন বিজেপি পুঁজিবাদের সেবার মাঠে রিলে রেসের প্রতিযোগীদের মতো কংগ্রেসের কাছ থেকে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাটনটা কেড়ে নিয়ে অনেক বেশি জোরে দৌড়চ্ছে। এটাই তফাত।
এবারের ভোটে দেখা গেল ইন্ডিয়া জোটের সব শরিক একেবারে কংগ্রেস থেকে শুরু করে তৃণমূল, অখিলেশ যাদবের সপা ইত্যাদিরা বিজেপি শাসনে মানুষের ওপর চলা অর্থনৈতিক চরম শোষণ, দারিদ্র, বেকারি নিয়ে কিছুটা প্রচার করেছে বটে, কিন্তু পাশাপাশি তাদের লক্ষ্য থেকেছে ধর্ম, জাতপাত ইত্যাদি নিয়ে প্রচার। এই রাজনীতি সাম্প্রদায়িকতার বিষকে আটকাতে পারে? এবারের ভোটে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এবং বিজেপি উভয় দলেরই প্রচারের মূল জোর ছিল হয় ধর্মকে কেন্দ্র করে, না হয় জাতপাত সংক্রান্ত। কংগ্রেস-সিপিএম জোটও এই লাইনের বাইরে যায়নি। অবশ্য এটাই হওয়ার ছিল। মার্ক্সবাদী বিজ্ঞান দেখিয়েছে দক্ষিণপন্থীরা তো বটেই এমনকি সংস্কারবাদী বামপন্থীরাও ভোটে লড়ে বিদ্যমান শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটার সেবক হওয়ার প্রতিযোগিতায় স্থান করে নেওয়ার লক্ষ্যে। একই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে চলা দলগুলির রাজনীতিতে নানা বাক্যের ছটা ছাড়া পার্থক্য বিশেষ নেই।
এর একেবারে বিপরীত মেরুতে আছে বিপ্লবী বামপন্থার রাজনীতি। যে রাজনীতির বাহকরা সংসদীয় রাজনীতির ময়দানে ভোটে যখন লড়ে, তারা পুঁজিবাদের সেবক পদের ভাগিদার হওয়ার লক্ষ্যে লড়ে না। তারা লড়ে একদিকে জনসাধারণের গণআন্দোলনের দাবিকে সংসদীয় মঞ্চে জোর গলায় তুলে ধরা ও এই পুঁজিবাদী সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতারণা ও অন্তঃসারশূন্য অবস্থাটা জনগণের চোখে স্পষ্ট করে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে।
এই বিপ্লবী বামপন্থার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এস ইউ সি আই (সি) একটা কথা বারবার জোর দিয়ে বলেছে– ভোটে বিজেপি-বিরোধী মানেই যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এমনটা ধরে নেওয়া চলে না। এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের মূল সমস্যা– দারিদ্র, বেকারি, অনাহার-অর্ধাহার, কৃষকের ফসলের দাম না পাওয়া ইত্যাদি নিয়ে ভোটের বাজারে দক্ষিণপন্থী থেকে শুরু করে বামপন্থী নামধারী দলগুলি কথা বলে মানুষকে উত্তেজিত করে তাদের মন জয়ের জন্য। কিন্তু এই সমস্যা নিয়ে জনগণকে সংগঠিত করে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তোলা ও মানুষকে তাদের সমস্যার মূল কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্বরূপ চিনিয়ে দেওয়া ও মূল শত্রু পুঁজিবাদের সেবক দলগুলিকে চেনানোর কাজটাকে তারা কৌশলে আড়াল করে। ভোট রাজনীতির ময়দানে তারা সমস্যা তুলে ধরে বলে ‘ওদের বদলে আমাদের আনো’ তোমাদের জীবনের সমস্যা তাতেই মিটে যাবে। ধর্মনিরপেক্ষ কথাটা মুখে বললেও তারা কখনও জাতপাতের রাজনীতি, কখনও প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়অর রাজনীতি করে। এতে বিজেপিকে ভোটে টেক্কা দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু এতেসাম্প্রদায়িক পরিবেশকে মোকাবিলা করা যায় না। আজ দরকার বামগণতান্ত্রিক শক্তিগুলির ঐক্যবদ্ধ জোরদার আন্দোলন। অথচ দেখা যাচ্ছে সিপিএমের মতো সংস্কারবাদী বামপন্থীরা দু’চারটি এমপি সিটে জেতার লোভে কংগ্রেসের মতো একচেটিয়া মালিকদের সেবাদাস ও জাতপাতভিত্তিক দলগুলিকেই বিজেপির বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি বলে তুলে ধরছে। এতে যেমন বিজেপির ছড়ানো সাম্প্রদায়িকতার বিষকে রোখা যাবে না, তেমনই জনগণের ঐক্যও মার খাবে। এতে হিন্দু-মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তিরই জমি উর্বর হবে, জাতপাতের বিভাজনে বাড়বে। এ জন্যই দক্ষিণপন্থা ও সংস্কারবাদী বামপন্থার একেবারে বিপরীত মেরুর বিপ্লবী বামপন্থার রাজনীতিকে চিনতে পারা ও জনজীবনে তার প্রতিষ্ঠা জরুরি।
বিজেপির হার মানুষ চেয়েছে, তাকে ধাক্কাও দিয়েছে। কিন্তু সেই মানুষের ভোট নিয়ে কংগ্রেস নেতারা যদি শিবের ছবি দেখানোর সস্তা রাজনীতি করে কুড়িয়ে নেওয়া হাততালিতেই খুশি থাকেন, কোনও সেকুলার বামপন্থী দল কি তাদের সাথে ঐক্য করতে পারে? আজ দরকার যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা, যা ধর্মকে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত চর্চার বিষয় হিসাবে দেখে। একই সাথে আজ বড় দরকার গণআন্দোলনের জোয়ার তোলা।
এস ইউ সি আই (সি) সেই ডাক দিয়েছে। ছাত্র-যুব-চাষি-শ্রমিকরাও আন্দোলনে সামিল হতে এগিয়ে আসছেন। প্রয়োজন ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের সংগঠিত শক্তির জন্ম দেওয়া, তাদের সচেতন করে তোলা– যাতে জনগণ নিজেরাই যথার্থ শত্রু-মিত্র চিনতে শেখে। একমাত্র এই পরিস্থিতি তৈরি করতে পারলেই শাসকশ্রেণির স্বার্থবাহী ছদ্ম জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সাহায্যে মানুষকে উলুখাগড়ার মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাজনীতিকে রোখা যাবে।