শুধু দখল নয়, শ্রমিক শ্রেণিকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতে হবে
এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লবক্স রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এ বার সপ্তম কিস্তি।
১৮৭১ সালের প্যারিস কমিউনের অভিজ্ঞতাঃ মার্কসের বিশ্লেষণ
১। কমিউনার্ডদের (প্যারিস কমিউন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যাঁরা লড়াই করেছিলেন) বীরত্বের উৎস কোথায় নিহিত?
এটা সকলেরই জানা যে, ১৮৭০ সালের শরৎকালে, কমিউনের কয়েক মাস আগে,প্যারিসের শ্রমিকদের সতর্ক করে মার্ক্স বলেছিলেন, সরকারকে উৎখাত করার যে কোনও প্রচেষ্টা অপরিণামদর্শী নির্বোধের মতো কাজ হবে। কিন্তু ১৮৭১ সালের মার্চ মাসে যখন একটা চূড়ান্ত লড়াই শ্রমিকদের ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল এবং শ্রমিকরা তার মুখোমুখি হলেন, অভ্যুত্থান যখন একটা বাস্তব ঘটনায় পর্যবসিত হল, প্রতিকূল পূর্বলক্ষণ সত্ত্বেও মার্ক্স এই সর্বহারা বিপ্লবকে অসীম উদ্দীপনার সঙ্গে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। মার্ক্সবাদের পথ থেকে ভ্রষ্ট, রাশিয়ার কুখ্যাত প্লেখানভের মতো কট্টর পণ্ডিতি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মার্ক্স এই আন্দোলন ‘অসময়োচিত’ বলে এর নিন্দা করেননি। প্লেখানভ ১৯০৫ সালের নভেম্বর মাসে শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রাম প্রসঙ্গে উদ্দীপনার সাথে লিখেছিলেন, কিন্তু ১৯০৫ সালের ডিসেম্বর মাসের পর এই প্লেখানভই উদারনীতিকদের ঢঙে চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া ওদের উচিত হয়নি।’
যাই হোক, কমিউনার্ডরা ‘স্বর্গ অধিকারের অসমসাহসী অভিযানে নেমেছিলক্স– এই মন্তব্য করে মার্ক্স কমিউনার্ডদের বীরত্ব নিয়ে শুধু উচ্ছ্বসিত প্রশংসাই করেননি, যদিও জনগণের বিপ্লবী আন্দোলন তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি, তবুও মার্ক্স এই সংগ্রামকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বলে মনে করতেন। একে মনে করতেন, বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের এক ধাপ অগ্রগতি। মনে করতেন, এ এমন একটা বাস্তব পদক্ষেপ যা শত সহস্র যুক্তিজাল ও কর্মসূচির তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মার্ক্স নিজের জন্য যে কর্তব্য নির্ধারণ করেছিলেন তা হল– এই পরীক্ষার অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করতে হবে, এর থেকে রণকৌশলগত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, এর আলোকে নিজের তত্ত্বের পুনর্মূল্যায়ণ করতে হবে।
প্যারিস কমিউনার্ডদের বিপ্লবী অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মার্ক্স কমিউনিস্ট ইশতেহারের একটা মাত্র ‘সংশোধন’ করা প্রয়োজন মনে করেছিলেন।
মার্কস-এঙ্গেলস ১৮৭২ সালের ২৪ জুন কমিউনিস্ট ইশতেহারের নতুন জার্মান সংস্করণের সর্বশেষ ভূমিকা লিখেছিলেন। এই ভূমিকায় তাঁরা লিখেছিলেন, কমিউনিস্ট ইশতেহারের কর্মসূচি ‘কোনও কোনও বিষয়ে অকার্যকর হয়ে গেছেক্স। তাঁরা আরও বললেনঃ
কমিউন বিশেষভাবে একটা জিনিস প্রমাণ করেছে। তা হল শ্রমিক শ্রেণি কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্রকে দখল করলেই নিজের স্বার্থে তাকে ব্যবহার করতে পারে না।
সুতরাং মার্কস-এঙ্গেলস প্যারিস কমিউনের একটা প্রধান ও মৌলিক শিক্ষাকে এতই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন যে, তাঁরা কমিউনিস্ট ইশতেহারের বিশেষ সংশোধন হিসাবে তা অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
এটা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ যে, সুবিধাবাদীরা এই গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীকেই বিকৃত করেছে। কমিউনিস্ট ইশতেহারের পাঠকদের মধ্যে একশো ভাগের নিরানব্বই ভাগ যদি নাও হয়, অন্তত নব্বই জনই সম্ভবত এর অর্থ বোঝেন না। পরে এই বিকৃতি নিয়ে আমরা বিস্তৃত আলোচনা করব। আলোচনা করব বিশেষভাবে বিকৃতি নিয়ে একটা অধ্যায়ে। এখানে উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে, মার্ক্সের যে বিখ্যাত বক্তব্য এইমাত্র উদ্ধৃত করা হল, তাকে এমন স্থূলভাবে বিকৃত করা হয়, যেন মার্ক্স ক্ষমতা দখল সহ অন্যান্য বিষয়ের পরিবর্তে ধীরগতিতে বিকাশের উপর জোর দিয়েছেন।
বাস্তবে, এর বিপরীতটাই সত্য। মার্কসের অভিমত হল, শ্রমিক শ্রেণিকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতে হবে, একে শুধু দখল করলেই চলবে না।
১৮৭১ সালের ১২ এপ্রিল, অর্থাৎ ঠিক প্যারিস কমিউনের সময়ে কুগেলমানকে মার্ক্স লিখেছিলেনঃ
‘আপনি যদি আমার অষ্টাদশ ব্রুমেয়ারের শেষ অধ্যায়টা দেখেন তাহলে দেখতে পাবেন, আমি বলেছি, আমলাতান্ত্রিক-সামরিক যন্ত্রটার আগের মতো হাত বদল করলেই চলবে না। আমি বলেছি, পরবর্তী ফরাসি বিপ্লবের প্রচেষ্টা হবে একে ধ্বংস করা। এবং এই মহাদেশে প্রতিটি সত্যিকারের গণবিপ্লবের এই হবে প্রাথমিক শর্ত। প্যারিসে আমাদের বীর কমরেডরা ঠিক এই কাজটা করারই চেষ্টা করছেন। (নিউয়ে জাইট, ২০ বর্ষ ১ম সংখ্যা, ১৯০১-১৯০২, পৃঃ ৭০৯) (কুগেলমানের কাছে লেখা মার্ক্সের চিঠিগুলি রুশ ভাষায় অন্তত দুটি সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। আমি একটির সম্পাদনা করেছি এবং তার ভূমিকা লিখেছি)।
বিপ্লবের সময়ে রাষ্ট্র প্রসঙ্গে সর্বহারা শ্রেণির কর্তব্য সম্পর্কে মার্ক্সবাদের প্রধান শিক্ষা সংক্ষেপে এই শব্দগুলির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে– ‘আমলাতান্ত্রিক-সামরিক বাহিনীকে ধ্বংস করতে হবেক্স। এবং সংক্ষেপে মার্ক্সের এই শিক্ষাকেই শুধু একেবারে ভুলে যাওয়া হয়েছে তাই নয়, বর্তমানে মার্ক্সবাদের কাউটস্কিপন্থী ‘ব্যাখ্যা’ একে একেবারেই বিকৃত করছে।
মার্ক্স যে অষ্টাদশ ব্রুমেয়ারের কথা উল্লেখ করেছেন, আমরা তার সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ পুরোপুরি উদ্ধৃত করলাম।
উপরে উদ্ধৃত মার্ক্সের যুক্তির বিশেষ করে দুটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। প্রথমত, তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত শুধু এই মহাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। ১৮৭১ সালে দাঁড়িয়ে এই বিষয়টা বোঝা যায়। তখন ইংল্যান্ড ছিল একটা খাঁটি পুঁজিবাদী দেশের আদর্শ উদাহরণ। তখন সেখানে কোনও সামরিক চক্র ছিল না, এবং আমলাতন্ত্রও প্রায় অনুপস্থিত ছিল বলা চলে। প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংস করার প্রাথমিক শর্ত বাদ দিয়ে সেখানে বিপ্লব, এমনকি গণবিপ্লবও সম্ভব ছিল বলে মনে করা হত এবং বাস্তবে তা সম্ভব ছিল। এই কারণে মার্ক্স ইংল্যান্ডকে বাদ রেখেছিলেন।
বর্তমানে ১৯১৭ সালে, প্রথম সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধের যুগে মার্ক্স-কথিত এই বৈশিষ্ট্য আর কার্যকর নয়। সারা দুনিয়ায় অ্যাংলো স্যাক্সন ‘স্বাধীনতারক্স সর্ববৃহৎ ও শেষ প্রতিনিধি হল ইংল্যান্ড ও আমেরিকা। এই অর্থে যে, এখানে কোনও সামরিক চক্র বা আমলাতন্ত্র ছিল না। কিন্তু আজ এই দুই দেশই গোটা ইউরোপ-জোড়া আমলাতান্ত্রিক-সামরিক প্রতিষ্ঠানের রক্তাক্ত পাঁকে পুরোপুরি ডুবে গেছে। সব কিছুই আজ এই আমলাতান্ত্রিক-সামরিক প্রতিষ্ঠানের অধীন, সব কিছুই আজ এর পদদলিত। বর্তমানে ইংল্যান্ডে এবং আমেরিকাতেও প্রতিটি যথার্থ গণবিপ্লবের শর্ত হল প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্রকে চূর্ণ করা, ধ্বংস করা। (এই দুই দেশই ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে ‘ইউরোপীয়’ সাধারণ সাম্রাজ্যবাদী মাপকাঠি অনুযায়ী নিজেদের পূর্ণতা ও উৎকর্ষের চরম সীমায় নিয়ে গিয়েছে)
দ্বিতীয়ত, আমলাতান্ত্রিক-সামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করাই হল প্রতিটি গণবিপ্লবের প্রাথমিক শর্ত– মার্ক্সের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। যাঁরা মার্ক্সবাদী হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতে চান, রাশিয়ার সেই প্লেখানভপন্থী ও মেনশেভিক এবং স্ট্রুভের অনুগামীদের কাছে মার্ক্সের মুখে গণবিপ্লবের কথা অদ্ভূত শোনাতে পারে। তাঁরা হয়ত বলতে পারেন, এই সব কথা মার্ক্সের মুখ-ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে। মার্ক্সবাদকে তাঁরা বিকৃত করতে করতে এমন শোচনীয় উদারনৈতিক মতবাদের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন যে, বুর্জোয়া বিপ্লব ও শ্রমিক বিপ্লবের মধ্যে বিরোধের অস্তিত্বের বাইরে আর কিছু তাঁরা দেখতে পান না। আর এই বিরোধেরও ব্যাখ্যা তাঁরা অত্যন্ত নিষ্প্রাণভাবে করেন।
বিশ শতকের বিপ্লবগুলিকে যদি আমরা উদাহরণ হিসাবে ধরি, তাহলে আমাদের স্বীকার করতে হবে পর্তুগাল ও তুরস্কের বিপ্লব– এই দুই বিপ্লবই বুর্জোয়া বিপ্লব। এই দুই বিপ্লবের কোনওটাই গণবিপ্লব নয়। কারণ, এই দুই বিপ্লবের কোনটাতেই ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবিদাওয়া নিয়ে লক্ষ্যণীয় মাত্রায় সক্রিয়ভাবে স্বাধীন চিত্তে অংশগ্রহণ করেনি। এর বিপরীতে, যদিও ১৯০৫-’০৭ সালের রাশিয়ার বুর্জোয়া বিপ্লব পর্তুগাল ও তুরস্কের বিপ্লবের মতো সেই ধরনের ‘চমৎকারক্স সাফল্যের মুখ দেখেনি, তবুও সেই বিপ্লব নিঃসন্দেহে গণবিপ্লব। কারণ, এই বিপ্লবে শোষণ-নিপীড়ন বিধ্বস্ত সমাজের নিচুতলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ স্বাধীনভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এবং বিপ্লবের সমগ্র প্রবাহে তাদের দাবিদাওয়া পেশ করেছিল। তাঁরা পুরনো সমাজকে ভেঙে তাদের নিজেদের পথে একটা নতুন সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল।
১৮৭১ সালে ইউরোপে কোনও দেশেই সর্বহারা শ্রেণি সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না। সেই বিপ্লবই গণবিপ্লব হতে পারত, তার প্রবাহে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে টেনে আনতে পারত, যদি সেই বিপ্লব নিজের গতিধারায় সর্বহারা ও কৃষক শ্রেণিকে নিয়ে আসতে পারত। জনসাধারণ তখন এই দুই শ্রেণিকে নিয়ে গঠিত ছিল। এই দুই শ্রেণি ঐক্যবদ্ধ ছিল, আমলাতান্ত্রিক-সামরিক রাষ্ট্রযন্ত্র এই দুই শ্রেণিকে নির্যাতন, নিষ্পেষণ, শোষণ করে, তাই এই দুই শ্রেণি ঐক্যবদ্ধ। এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য, চূর্ণ-বিচূর্ণ করার জন্য এই ঐক্য জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের, শ্রমিক শ্রেণি ও অধিকাংশ কৃষকদের যথার্থ স্বার্থে প্রয়োজন ছিল। সর্বহারা শ্রেণির ও গরিব কৃষকদের মধ্যে স্বাধীন মৈত্রীর জন্য এটা প্রাথমিক শর্ত। এই ঐক্য ছাড়া গণতন্ত্র স্থায়ী হতে পারে না এবং সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সবাই জানেন, প্যারিস কমিউন নিঃসন্দেহে এই ধরনের মৈত্রীর দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। যদিও আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নানা কারণের জন্য সে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি।
কাজেই, যথার্থ গণবিপ্লবের কথা বলতে গিয়ে, মার্ক্স পেটি বুর্জোয়াদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা একটুও ভুলে যাননি (তাদের সম্পর্কে তিনি প্রায়ই অনেক কথা বলেছেন), ১৮৭১ সালের ইউরোপের অধিকাংশ দেশের শ্রেণি ভারসাম্যের বিষয়টি তিনি খুব গুরুত্ব দিয়ে হিসাবের মধ্যে রেখেছেন। অন্যদিকে তিনি বলেছেন, শ্রমিক, কৃষক– উভয়ের স্বার্থেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করা দরকার। এই কাজ তাদের ঐক্যবদ্ধ করে, তাদের সামনে এক সাধারণ কর্তব্য উপস্থিত করে– ‘পরজীবী’ উচ্ছেদ করে সে জায়গায় নতুন কিছু প্রতিষ্ঠা করা।
সেই ‘নতুন কিছু ঠিক কী?’ (চলবে)