বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে।এ বার পঞ্চদশ কিস্তি।
মানুষের বিরুদ্ধে সমস্ত ধরনের বলপ্রয়োগের বিলোপ ঘটানোই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য
গণতন্ত্রকে পরাস্ত করা প্রসঙ্গে এঙ্গেলস
এই বিষয়টি নিয়ে এঙ্গেলস তাঁর মত প্রকাশ করেন ‘সোসাল-ডেমোক্র্যাট’ কথাটি যে বিজ্ঞানের দিক থেকে ভুল, সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে।
১৮৭০-এর দশকে নানা বিষয়ে, প্রধানত ‘আন্তর্জাতিক’ বিষয়ে লেখা প্রবন্ধগুলির এক সংকলনের ভূমিকা লেখেন এঙ্গেলস। ১৮৯৪-এর ৩ জানুয়ারি, অর্থাৎ মৃত্যুর দেড় বছর আগে লেখা এই ভূমিকাটিতে তিনি বলেন যে, সমস্ত প্রবন্ধে তিনি ‘সোসাল ডেমোক্র্যাট’ কথাটি না লিখে ‘কমিউনিস্ট’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কারণ, ওই সময়ে ফ্রান্সে প্রুধোঁপন্থীরা এবং জার্মানিতে লাসালের অনুগামীরা নিজেদের সোসাল ডেমোক্র্যাট বলতেন।
এঙ্গেলস লিখেছেন, ‘‘আমাদের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য মার্ক্স ও আমার পক্ষে তাই এমন একটি নমনীয় শব্দ নির্বাচন করা সম্ভব ছিল না। আজকাল ব্যাপার অন্য রকম। এই কথাটি (সোসাল ডেমোক্র্যাট) হয়ত এখন উতরে যাবে। যদিও যে পার্টির অর্থনৈতিক কর্মসূচি সাধারণভাবে শুধু সমাজতান্ত্রিক নয় বরং সরাসরি কমিউনিস্ট, যার চূড়ান্ত রাজনৈতিক লক্ষ্য হল গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এবং সেই অর্থে গণতন্ত্রকেও পরাস্ত করা, তেমন পার্টির ক্ষেত্রে এই নাম অনুপযুক্ত। যাই হোক, প্রকৃত (শব্দটি এঙ্গেলসই বাঁকানো হরফে লিখেছেন) রাজনৈতিক দলের নাম কখনওই সম্পূর্ণ যথাযথ হয় না। পার্টি বিকাশ লাভ করে, নাম চালু থেকে যায়।’’
দ্বন্দ্বতাত্ত্বিক এঙ্গেলস জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দ্বন্দ্বতত্তে্ব বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বলেছেন, মার্ক্স ও আমি পার্টির জন্য বিজ্ঞানসম্মত ভাবে যথাযথ একটা চমৎকার নাম ঠিক করেছিলাম, কিন্তু কোনও যথার্থ পার্টি, সর্বহারার গণপার্টি ছিল না। এখন (উনিশ শতকের শেষ ভাগে) একটা যথার্থ পার্টি আছে, কিন্তু তার নাম বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যথাযথ নয়। তবে ভাবনা নেই, ওতেই ‘কাজ চলে যাবে’। শুধু যদি পার্টিটা বাড়ে, তার নামটি যে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে সঠিক নয়, শুধু যদি তা পার্টির কাছে গোপন না থাকে এবং পার্টির সঠিক পথে বিকাশে তা বাধা সৃষ্টি না করে, তবে সেই নামেই কাজ চলে যাবে!
কোনও রসিক ব্যক্তি এঙ্গেলসের ধরনে আমাদের বলশেভিকদের হয়তো এই বলে সান্ত্বনা দেবেন যে, আমাদের একটা প্রকৃত পার্টি আছে, চমৎকারভাবে সেই পার্টি বাড়ছে। ১৯০৩ সালে ব্রাসেলস-লন্ডন কংগ্রেসে ঘটনাচক্রে আমরা ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ১। ‘বলশেভিক’ শব্দটিতে এই আকস্মিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া অন্য কিছু না বোঝালেও এ রকম একটি অর্থহীন ও কদাকার শব্দই পরীক্ষায় ‘উতরে যাবে’। জুলাই ও আগস্ট মাসে২ প্রজাতন্ত্রী ও ‘বিপ্লবী’ পেটি বুর্জোয়াদের গণতন্ত্র আমাদের দলের উপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, তাতে ‘বলশেভিক’ নামটি এখন সর্বত্রই শ্রদ্ধাস্পদ হয়ে উঠেছে। এ ছাড়াও, আমাদের দল সত্যকার বিকাশের পথে যে বিরাট ঐতিহাসিক অগ্রগতি ঘটিয়েছে, এই নির্যাতন তারই সঙ্কেত। এপ্রিল মাসে পার্টির নাম বদলের যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, এই অবস্থায় সেই প্রস্তাবে অনড় থাকতে আমিও এমনকি দ্বিধাবোধ করব। কমরেডদের কাছে আমি হয়তো একটা ‘আপসে’র প্রস্তাব দেব, অর্থাৎ আমাদের কমিউনিস্ট পার্টি নামে অভিহিত করে বন্ধনীর মধ্যে ‘বলশেভিক’ কথাটা রাখার প্রস্তাব দেব।
কিন্তু, রাষ্ট্রের প্রতি বিপ্লবী সর্বহারার মনোভাবের তুলনায় পার্টির নামের প্রশ্নটি কম গুরুত্বপূর্ণ।
রাষ্ট্র সম্পর্কে প্রচলিত আলোচনায় বরাবর যে ভুলটি করা হয়, তার বিরুদ্ধে এঙ্গেলস হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এবং কথা প্রসঙ্গে তা আমরা আগে উল্লেখ করেছি। এই ভুলটি হলঃ নিরন্তর ভুলে যাওয়া হয় যে রাষ্টে্রর বিলোপ মানে গণতন্ত্রেরও বিলোপ, ক্ষয় পেতে পেতে রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মানে গণতন্ত্রেরও ক্ষয় পেতে পেতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া।
প্রথম দৃষ্টিতে এই কথাকে মনে হবে চূড়ান্ত রকমের অদ্ভূত ও অবোধ্য। এমনকি কেউ কেউ হয়তো এমন আশঙ্কা করতে পারেন যে, আমরা এমন এক সমাজব্যবস্থার আবির্ভাব আশা করছি যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে সংখ্যালঘিষ্ঠের অধীনতার নীতি মানা হবে না। কারণ, গণতন্ত্র মানে এই নীতিকেই স্বীকৃতি দেওয়া নয় কি?
না, গণতন্ত্র আর সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে সংখ্যালঘিষ্ঠের আনুগত্য এক নয়। গণতন্ত্র হল একটা রাষ্ট্র, যেখানে সংখ্যাগুরুরপ্রতি সংখ্যালঘু আনুগত্য স্বীকার করে। অর্থাৎ গণতন্ত্র হল এক শ্রেণি কর্তৃক অপর শ্রেণির বিরুদ্ধে, জনসাধারণের এক অংশ কর্তৃক অপর অংশের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভাবে বলপ্রয়োগের এক সংগঠন।
রাষ্ট্রের বিলোপ, অর্থাৎ সমস্ত সংগঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ বলপ্রয়োগের, সাধারণ ভাবে মানুষের বিরুদ্ধে সমস্ত ধরনের বলপ্রয়োগের বিলোপ ঘটানোই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে আমরা স্থির করেছি।
আমরা এমন একটি সমাজব্যবস্থার উদ্ভব আশা করি না যেখানে সংখ্যাগুরুর প্রতি সংখ্যালঘুর আনুগত্যের নীতি মেনে চলা হবে না। কিন্তু সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে করতে আমাদের এই দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে যে, এই সমাজ বিকশিত হতে হতে সাম্যবাদী সমাজে রূপান্তরিত হবে। এবং তাই, সাধারণভাবে মানুষের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের কোনও প্রয়োজন থাকবে না। একজনের প্রতি আরেক জনের, এক অংশের মানুষের প্রতি অপর অংশের মানুষের বশ্যতার প্রয়োজন লোপ পাবে। কারণ, বলপ্রয়োগ ছাড়াই, বশ্যতা ছাড়াই জনসাধারণ সামাজিক জীবনের প্রাথমিক শর্তগুলি পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
অভ্যাসের এই বিষয়টিতে জোর দেওয়ার জন্য এঙ্গেলস এক নতুনপ্রজন্মের কথা বলেছেন, যে প্রজন্ম ‘‘নতুন ও স্বাধীন সামাজিক পরিবেশে লালিত পালিত হবে’’, যে প্রজন্ম গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র সহ সব ধরনের রাষ্ট্রকে, ‘‘রাষ্ট্রের গোটা জঞ্জালস্তূপকে আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে সক্ষম হবে’’।
এই বিষয়টা ব্যাখ্যা করার জন্য রাষ্ট্রের ক্রমে ক্ষয় পেতে পেতে অবলুপ্ত হওয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তির প্রশ্নটি আলোচনা করা প্রয়োজন। (চলবে)
ফুট নোট
১ঃ এখানে ১৯০৩-এর জুলাই-আগস্টে অনুষ্ঠিত রুশ সোসাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের কথা বলা হয়েছে। এই কংগ্রেস প্রথম বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে বসে। কিন্তু পুলিশের তাড়ার কারণে জায়গা পরিবর্তন করে লন্ডনে কংগ্রেস হয়।পার্টির ইতিহাসে এই দ্বিতীয় কংগ্রেস বিরাট ভূমিকা পালন করে। এই কংগ্রেসেই কার্যত রুশ সোসাল ডেমেক্র্যাটিক লেবার পার্টি (আরএসডিএলপি) গঠিত হয়। এই কংগ্রেসেই দলের কর্মসূচি ও নিয়ম-নীতি গৃহীত হয়েছিল এবং পার্টির কেন্দ্রীয় প্রধান অঙ্গগুলি গঠিত হয়েছিল। আরএসডিএলপি-র মধ্যে লেনিন-নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী ধারা ও মার্তভ-নেতৃত্বাধীন সুবিধাবাদী ধারা– এই দুই ধারার মধ্যে মূলত সংগঠনের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে সংগ্রাম শুরু হয় এই কংগ্রেসেই।পরিণামে পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়– বলশেভিক ও মেনশেভিক। পার্টির কেন্দ্রীয় প্রধান অঙ্গগুলির নির্বাচনী ফলাফলের সঙ্গে এই নামদুটি যুক্ত। এই কংগ্রেসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে লেনিনের অনুগামীরা যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েছিলেন, সেই সময় থেকে তাঁদের ‘বলশেভিক’ নামে ডাকা হতে থাকে (রুশ ভাষায় বলশেভিক কথাটির অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ), এবং লেনিনের বিরোধীরা যারা নির্বাচনে কম ভোট পেয়েছিল, সেই সময় থেকে তাঁদের ‘মেনশেভিক’ বলা শুরু হয় (রুশ ভাষায় মেনশেভিক মানে সংখ্যালঘিষ্ঠ)।
২ঃ এখানে ১৯১৭ সালের ৩-৫ জুলাই পেট্রোগ্রাদের ঘটনাগুলির কথা বলা হয়েছে। সেই সময় সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে শ্রমিক ও সৈন্যরা বড় বড় মিছিলে সামিল হচ্ছিলেন। শান্তিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, কেরেনস্কির নেতৃত্বাধীন বুর্জোয়া অস্থায়ী সরকার মিছিলের উপর সৈন্য লেলিয়ে দিয়েছিল।মিছিল বন্ধ করে দেওয়ার পর সরকার বলশেভিক পার্টির উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। তারা বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র ‘প্রাভদা’ বন্ধ করে দেয় এবং লেনিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। লেনিন আত্মগোপন করতে বাধ্য হন।বলশেভিক পার্টির সামনের সারির বেশ কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হন। এ সব সত্তে্বও লেনিন ও স্ট্যালিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি ১৯১৭ সালে অক্টোবর (নভেম্বর) বিপ্লবে সর্বহারা শ্রেণির জয়লাভের ক্ষেত্র প্রস্তুতে সমর্থ হয়।