এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে গণদাবীতে তাঁর ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। এটি প্রথম কিস্তি।
রাষ্ট্র হল অনিরসনীয় শ্রেণি-বিরোধের ফল
নিপীড়িত শ্রেণিগুলির মুক্তি সংগ্রামে তাদের চিন্তানায়কদের মতবাদের ক্ষেত্রে ইতিহাসে একাধিকবার যা ঘটেছে, বর্তমানে তাই ঘটছে মার্ক্সের মতবাদ নিয়েও। মহান বিপ্লবীদের জীবদ্দশায় উৎপীড়কেরা তাঁদের ওপর অবিরাম নিগ্রহ চালিয়েছে, তাঁদের মতবাদকে আক্রমণ করেছে অতি হিংস্র বিদ্বেষে, অতি ক্ষিপ্ত ঘৃণায় এবং মিথ্যা ও কুৎসার অতি বেপরোয়া অভিযানে। মৃত্যুর পর চেষ্টা হয়েছে তাঁদের নিরীহ দেবমূর্তিতে পরিণত করতে, বলা যায়, তাদের উপর সাধুর মাহাত্ম্য আরোপ করা হয়, নিপীড়িত শ্রেণিগুলির ‘সান্ত্বনার’ জন্য, তাদের বোকা বানাবার জন্য।
এ জন্য মহান বিপ্লবীদের বৈপ্লবিক মতবাদের মর্মবস্তুকে বিসর্জন দিয়ে, তার বৈপ্লবিক ধার ভোঁতা করে, তাকে ছেঁদো করে তুলে, তাঁদের নামের পাশে খানিকটা জ্যোতি আরোপ করার চেষ্টা চলে। মার্কসবাদের এই রকম বিকৃতীকরণে বর্তমানে হাত মেলাচ্ছে বুর্জোয়ারা এবং শ্রমিক আন্দোলনের ভেতরকার সুবিধাবাদীরা। তারা ত্যাগ করছে, অস্পষ্ট করে দিচ্ছে, বিকৃত করছে মতবাদের বিপ্লবী দিকটা, তার বৈপ্লবিক প্রাণসত্তাটা। বুর্জোয়াদের কাছে যা গ্রহণযোগ্য, বা যা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে সেইটাকে তারা তুলে ধরছে প্রধান করে, জয়গান গাইছে তার। সমস্ত উৎকট স্বাদেশিকতাবাদীরাই (সোস্যাল শোভিনিস্ট) এখন ‘মার্ক্সবাদী’– ঠাট্টা নয়! মার্ক্সবাদ সংহারে বিশেষজ্ঞ, গতকালের সমস্ত জার্মান বুর্জোয়া পণ্ডিতই এখন ঘন ঘন বলছেন ‘জার্মান জাতীয়’ মার্ক্সের কথা, যিনি নাকি অমন চমৎকার সংগঠিত শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে গেছেন লুঠেরা যুদ্ধ চালাবার জন্য!
অবস্থা এই হওয়ায়, মার্ক্সবাদের বিকৃতির এমন অভূতপূর্ব প্রচার লাভ করায় আমাদের প্রধান কর্তব্য হল রাষ্ট্র বিষয়ে মার্ক্সের আসল শিক্ষার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তার জন্য মার্ক্স ও এঙ্গেলসের নিজস্ব রচনা থেকে একগুচ্ছ দীর্ঘ উদ্ধৃতি তুলে ধরা প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে বক্তব্য গুরুভার হয়ে ওঠে, জনগণের বোধগম্য হয়ে ওঠায় খানিকটা অসুবিধা হয়। কিন্তু তা বাদ দিয়ে চলা একেবারেই অসম্ভব। মার্ক্স ও এঙ্গেলসের রচনার বিষয়ে যেখানে উল্লেখ আছে তেমন সমস্ত জায়গা, অন্তত নির্ধারক জায়গাগুলিকে যথাসম্ভব সম্পূর্ণাকারে আবশ্যিকভাবেই উদ্ধৃত করা উচিত, তাতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্তে্রর প্রতিষ্ঠাতাদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, সে দৃষ্টির বিকাশ সম্পর্কে পাঠক স্বাধীনভাবে একটা ধারণা লাভ করবেন, সেই সঙ্গে বর্তমানে আধিপত্যকারী ‘কাউটস্কিপন্থীরা’ তাদের যেসব বিকৃতি ঘটিয়েছে তা দলিলপত্র সহকারে প্রমাণিত ও জাজ্বল্যমান রূপে প্রদর্শিত হবে।
শুরু করা যাক ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সর্বাধিক প্রচারিত রচনা ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ দিয়ে, ১৮৯৪ সালে স্টুটগার্ট থেকে তার ৬ষ্ঠ সংস্করণ ইতিমধ্যেই বেরিয়েছে। আমাদের অনুবাদ করে দিতে হচ্ছে মূল জার্মান থেকে, কেন না বহু রুশ অনুবাদ থাকলেও তার অধিকাংশই হয় অসম্পূর্ণ, নয় একেবারেই সন্তোষজনক নয়। নিজের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের খতিয়ান টেনে এঙ্গেলস বলছেন
‘রাষ্ট্র মোটেই বাইরে থেকে সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটি শক্তি নয়, সেই সঙ্গে, হেগেল যা বলতেন, ‘নৈতিক ভাবের বাস্তবতা’, ‘প্রজ্ঞার প্রতিচ্ছবি ও বাস্তবতা’ও নয়। রাষ্ট্র হল একটা নির্দিষ্ট পর্বে সমাজের বিকাশের ফল; রাষ্ট্র হল এই স্বীকৃতি যে, সমাজটা অনিরসনীয় স্ববিরোধে জড়িয়ে পড়েছে, এমন আপসহীন বৈপরীত্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে যা থেকে মুক্তিলাভে সে অক্ষম। এই বৈপরীত্যগুলি, বিরোধী অর্থনৈতিক স্বার্থসম্পন্ন শ্রেণিগুলি যাতে নিষ্ফল সংগ্রামে নিজেদের ও সমাজকে ধ্বংস করে না বসে, তার জন্য দরকার পড়েছিল এমন একটি শক্তির যা দৃশ্যত সমাজের ঊর্ধ্বে দণ্ডায়মান, যা সংঘর্ষকে প্রশমিত করে আনবে, তাকে ‘শৃঙ্খলার’ সীমানার মধ্যে ধরে রাখবে। সমাজ থেকে উদ্ভূত কিন্তু সমাজের ঊর্ধ্বে আত্মপ্রতিষ্ঠিত, ক্রমেই বেশি করে সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে তোলা এই শক্তিই হল রাষ্ট্র।’ (১৭৭-১৭৮ পৃঃ, ৬ষ্ঠ জার্মান সংস্করণ।)
এখানে রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও তার তাৎপর্যের প্রশ্নে মার্ক্সবাদের মূল ভাবনা অভিব্যক্ত হয়েছে পরিপূর্ণ স্পষ্টতায়। রাষ্ট্র হল অনিরসনীয় শ্রেণি-বিরোধের ফল ও অভিব্যক্তি। রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় সেইখানে, সেই সময়, এবং সেই পরিমাণে, যেখানে, যে সময় এবং যে পরিমাণে বাস্তব ক্ষেত্রে শ্রেণিবিরোধ অমীমাংসিত থেকে যায়। এবং বিপরীতপক্ষে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, শ্রেণি-বিরোধের নিরসন অসম্ভব।
এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক পয়েন্টটি থেকেই শুরু হয় মার্কসবাদের বিকৃতি– যা চলছে দুটি প্রধান ধারায়।
একদিকে, তর্কাতীত ঐতিহাসিক ঘটনায় যাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে, রাষ্ট্র আছে শুধু সেইখানে, যেখানে আছে শ্রেণি-বিরোধ ও শ্রেণিসংগ্রাম, সেই সব বুর্জোয়া ও বিশেষ করে পেটি বুর্জোয়া মতবাদের প্রবক্তারা মার্ক্সকে একটু ‘শুধরে নিচ্ছেন’ এই ভাবে, যেন রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণি-মিটমাটের সংস্থা। মার্ক্সের মতে শ্রেণিবিরোধ মিটমাট সম্ভব হলে রাষ্টে্রর উদ্ভবও হত না, তা টিকেও থাকত না। এটাকে দেখিয়ে মধ্যবিত্ত ও কূপমণ্ডুক অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিকরা প্রায়শই মার্ক্সের ভক্ত সেজে এই কথাটাকেই উপস্থিত করে এ ভাবে যে, রাষ্ট্র নাকি ঠিকভাবে শ্রেণি-মিটমাটই করে থাকে। মার্ক্সের মতে, রাষ্ট্র হল শ্রেণি-শাসনের যন্ত্র, এক শ্রেণি কর্তৃক অপর শ্রেণিকে পীড়নের হাতিয়ার, রাষ্ট্র হল এমন ‘শৃঙ্খলার’ প্রতিষ্ঠা, যাতে শ্রেণি-সংঘাত প্রশমিত করে এই পীড়নকে বিধিবদ্ধ করে ও স্থায়িত্ব দেয়। পেটি বুর্জোয়া রাজনীতিকদের মতে, শৃঙ্খলার মানে এক শ্রেণি কর্তৃক অপর শ্রেণির পীড়ন নয়, একান্তরূপেই শ্রেণি-মিটমাট; সংঘাত প্রশমিত করার মানে নাকি মিটমাট করা, নিপীড়ক শ্রেণিকে উচ্ছেদের সংগ্রামে নিপীড়িত শ্রেণির হাতে যা আছে তার নির্দিষ্ট কিছু উপায় ও উপকরণ ছিনিয়ে নেওয়া নয়।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, ১৯১৭ সালের বিপ্লবে যখন রাষ্ট্রের তাৎপর্য ও ভূমিকার প্রশ্নটি তার সমস্ত ব্যাপকতা নিয়ে সামনে দাঁড়ায়, কার্যক্ষেত্রে তা যখন হয়ে দাঁড়ায় অবিলম্বে কার্যকরী পদেক্ষেপ নেওয়ার প্রশ্ন, তদুপরি সামগ্রিক ভাবে তা প্রয়োগের প্রশ্ন, তখন সমস্ত সোস্যালিস্ট রেভলিউশানারি ও মেনশেভিকরা তৎক্ষণাৎ এই পেটি বুর্জোয়া তত্তে্ব নেমে যায় যে, রাষ্টে্রর কাজ শ্রেণিবিরোধকে মিটমাট করা। এই দুই পার্টির রাজনীতিকদের অসংখ্য প্রস্তাব ও প্রবন্ধ ‘মিটমাটের’ এই মধ্যবিত্ত ও কূপমণ্ডুক তত্ত্বে পুরোপুরি আচ্ছন্ন। রাষ্ট্র যে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রভুত্বের সংস্থা, এ শ্রেণি যে তার প্রতিপক্ষের (তার বিপরীত শ্রেণির) সঙ্গে মিটমাট করে নিতে পারে না, পেটি বুর্জোয়া গণতন্ত্র এ কথা কখনওই বুঝতে পারে না। আমাদের সোসালিস্ট রেভলিউশানারি ও মেনশেভিকরা যে আদৌ সমাজতন্ত্রী নয় (যেটা আমরা বলশেভিকরা বরাবর দেখিয়ে এসেছি), প্রায়-সমাজতান্ত্রিক বুলিওয়ালা পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রী মাত্র, তার অতি জাজ্বল্যমান একটি প্রকাশ হল রাষ্ট্রের প্রতি তাদের মনোভাব।
অন্য দিকে, মার্ক্সবাদের ‘কাউটস্কি-মার্কা’ বিকৃতিটা অনেক সুক্ষ্ম। রাষ্ট্র শ্রেণি-শাসনের যন্ত্র, অথবা শ্রেণি বিরোধ অনিরসনীয়– এর কোনওটাই তারা ‘তত্ত্বের দিক থেকে’ অস্বীকার করে না। কিন্তু নজরে পড়ছে না অথবা ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে এই কথাটা যে রাষ্ট্র যদি হয় অনিরসনীয় শ্রেণি-বিরোধের ফল, তা যদি হয় সমাজের ঊর্ধ্বে দণ্ডায়মান ও ‘ক্রমেই বেশি করে সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে তোলা’ এক শক্তি, তা হলে এ কথা পরিষ্কার যে শুধু, সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়াই নয়, রাষ্ট্রশক্তির যে যন্ত্রটা প্রভুত্বকারী শ্রেণির সৃষ্টি, যার মধ্যে এই ‘বিচ্ছিন্নতা’ রূপ পেয়েছে, তাকেও বিলুপ্ত না করে নিপীড়িত শ্রেণির মুক্তি অসম্ভব। আমরা পরে দেখাব, মার্ক্স ইতিহাসম্মত সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের শক্তির জোরে বিপ্লবের কর্তব্য সম্বন্ধে যে স্পষ্ট সিধান্তে উপনীত হয়েছিলেন তা তত্ত্বগত ভাবে নিজেই নিজেকে সত্য বলে প্রমাণ করে। ঠিক এই সিদ্ধান্তটাই কাউটস্কি ‘ভুলে বসেছেন’ ও বিকৃত করেছেন, পরে আমরা বিশদে তা দেখাব।