রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে কীভাবে বিজেপির দলীয় দখলে আনার চেষ্টা চলছে, তা সম্প্রতি জানা গেছে তথ্যের অধিকার আইনে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার করা এক প্রশ্নের মাধ্যমে। জানা গেছে ৬৭টি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ৮৬ জন ডিরেক্টর বিজেপি ঘনিষ্ঠ বলেই পদলাভ করেছেন। ভারত হেভি ইলেকট্রিকাল (ভেল), ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (সেল), হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন, পেট্রোপণ্য এবং প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রকের অধীনস্থ গেল, পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া, শিপিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া, রাষ্ট্রীয় ইস্পাত নিগম, হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস-এর মতো সংস্থাগুলি রয়েছে এই তালিকায়।
সরাসরি বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরাও এক একটা সংস্থার মাথা হয়ে বসেছেন। উত্তরপ্রদেশ বিজেপির সহ-কোষাধ্যক্ষ মণীশ কাপুর হয়েছেন ভেল-এর ডিরেক্টর। গোয়া বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার এবং সেখানকার প্রাক্তন মন্ত্রী রাজেন্দ্র আরলেকর এখন ইন্ডিয়ান অয়েলের মাথায়। ছত্তিশগড় বিজেপির প্রাক্তন সহ-সভাপতি, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং বিধায়ক লতা উসেন্দিও বসেছেন ইন্ডিয়ান অয়েলের ডিরেক্টরের চেয়ারে। কর্ণাটক বিজেপির কার্যনির্বাহী সদস্য এন শঙ্করাপ্পা সেল-এর ডিরেক্টর। মহারাষ্ট্রের বিজয় তুলসিরামজি জাধাও শিপিং কর্পোরেশনের প্রধান।
তালিকা এখানেই শেষ নয়। এনএলসি ইন্ডিয়া ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়ার কর্তাও বিজেপি। এনবিসিসি (ইন্ডিয়া), হিন্দুস্তান কপার, এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়া, গার্ডেনরিচ শিপ বিষ্প্রর্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স, ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন, ওয়েস্টার্ন কোলফিল্ড লিমিটেডের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির মাথাতেও রয়েছেন বিজেপি ঘনিষ্ঠরা।
এঁরা কি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজেদের ক্ষমতা ও যোগ্যতার জোরে এই সমস্ত পদে নিযুক্ত হয়েছেন, নাকি তাঁদের যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি বিজেপির আস্থাভাজন হওয়া? ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্সের এক প্রশ্নের উত্তরে জানা যায়, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিতে স্বাধীন ডিরেক্টর নিয়োগের প্রক্রিয়াটাই আর স্বাধীন নেই। অভিজ্ঞতার নিরিখে নিয়োগের চেয়ে রাজনৈতিক যোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিই প্রাধান্য পান।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন বিচারপতি অরুণ মিশ্র। তাঁর নিয়োগের বিরুদ্ধতা করে ৭০ জন বিশিষ্ট মানুষ সই করে বিবৃতি দিয়েছেন। বলেছেন, বিচারপতি মিশ্রের নিয়োগ প্রোটেকশন অফ হিউম্যান রাইটস (পিএইচআর)-এর প্যারিস নীতিকে লঙ্ঘন করেছে। এই প্রথম কোনও প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য কেউ চেয়ারপার্সন হলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের। বিচারপতি আসনে থাকাকালীন তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাঁর বিচারপতি জীবনের একেবারে শেষলগ্নে আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের তোলা অভিযোগ জনমানসে এ প্রশ্ন জাগিয়েই রেখে গেছে। অবসরের পরই রীতি ভেঙে এই পদপ্রাপ্তি তাই প্রশ্ন তুলবেই।
তাঁর সুপ্রিম কোর্টের কার্যকালে বিচারপতি মিশ্র ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্টকে দুর্বল করে লক্ষ লক্ষ বনবাসী মানুষকে উচ্ছেদের নির্দেশ, ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণে বিজেপি সরকারের আগ্রাসী ভূমিকার প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছেন। জমি থেকে হাজার হাজার মানুষকে উচ্ছেদের জন্য জমি অধিগ্রহণের কালা নির্দেশ তিনি জারি করেছেন। বিজেপিও তাঁর ঋণ শোধ করছে বলেই আইনজীবী মহলের ধারণা। বিচারপতি লোয়া হত্যা-মামলার বিচারক হিসাবে তাঁর ভূমিকাও প্রশ্নের সামনে। এই মামলার ভার বিচারপতি মিশ্রের হাতে দেওয়ার প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবীরা। আইনজীবী দুষ্মন্ত দাভে বলেছিলেন, বিচারপতি মিশ্রের সাথে বিজেপির ঘনিষ্ঠতা কারও অজানা নয়, ফলে এই মামলা থেকে তাঁর নাম প্রত্যাহার করা হোক। প্রসঙ্গত, বিচারপতি লোয়ার রহস্যজনক মৃত্যুতে অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিজেপি নেতা অমিত শাহ। দেশের বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে আজ এমনি প্রশ্ন ওঠেনি! বিশেষ কিছু শিল্পগোষ্ঠীর সুবিধা পেয়ে যাওয়ার সাথেও তাঁর নাম জড়িয়েছে। কিন্তু সদুত্তর আসেনি।
প্রশাসন, বিচারালয়, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পরিচালকমণ্ডলীতে দলদাস করার চেষ্টা কংগ্রেসও করেছে। কিন্তু বিজেপি আরও নগ্ন, আরও আগ্রাসী। এইভাবে বিভিন্ন সংস্থাগুলির চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ করে সেগুলিকে নিজেদের কবজায় আনছে সরকার। কর্পোরেট পুঁজির পায়ে দাসখত লেখানো বিজেপি সরকার এই কর্তৃত্ব কায়েমের ফলেই সংস্থার ভেতর থেকে বিনা বিরোধিতায় সহজেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্নিকরণ করতে পারছে। বিরোধী কণ্ঠ প্রায় থাকছে না। ফলে তাদের সংস্থা বেচে দেওয়ার নীতি দ্রুত রূপায়ণে সুবিধা হচ্ছে। এইভাবে স্বাধীনতা পরবর্তীকালের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধীনতা চূড়ান্তভাবে হরণ করা হচ্ছে। বেআইনি ভাবে, গায়ের জোরে, নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে শাসক দল এই সংস্থাগুলির উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে। এ তো প্রশাসনিক ফ্যাসিবাদেরই নগ্ন রূপ।
কর্পোরেট পুঁজির অনুগত বিজেপি সরকার তার প্রভুদের লুঠের বাজার চাঙ্গা রাখতে একের পর এক জনবিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে। এই সমস্ত জনস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপের কোনও রকম প্রতিবাদও যাতে না হয় তার জন্য পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগাচ্ছে। আর যদি প্রতিবাদরত মানুষদের অধিকার হরণের প্রশ্ন ওঠে, মানবাধিকার কমিশনে আস্থাভাজন লোক বসিয়ে তাও নিয়ন্ত্রণ করার পথ খুলে রেখেছে বিজেপি সরকার।
তাহলে কি প্রতিবাদের শক্তি কোথাও নেই? সবাই কি স্তাবক? একদমই নয়। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন আজ দেশের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। এনআরসি বিরোধী আন্দোলন চলছে দেশব্যাপী। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে শ্রমিক কর্মচারী সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করছেন। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে ইতিমধ্যেই রাজ্যে তৈরি হয়েছে নাগরিক প্রতিরোধ মঞ্চ। ফলে সমস্যার পাশাপাশি সমাধানের সংগ্রামও আছে। এটাই আশার আলো।