২০১৪ সালে দেশের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর পার্লামেন্ট ভবনের দরজায় ভাবী প্রধানমন্ত্রীর সাষ্টাঙ্গ প্রণামের স্থির চিত্র কিম্বা লাইভ টেলিকাস্ট সারা দেশ দেখেছিল৷ এই সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের আত্মনিবেদন কিংবা কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার প্রকাশ নয়, এর তাৎপর্য সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং গভীরতর৷ তাই সদাপ্রস্তুত সংগঠিত প্রচারযন্ত্র ঘটনাটিকে ব্যাপক ভাবে পরিবেশন করেছিল৷ দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রীর কাছে পার্লামেন্ট ভবনও এক দেবমন্দির। গণতন্ত্রের প্রতি কি অচলাভক্তি। দেশবাসী নাকি মুগ্ধ।
তারপর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছু দিন পরে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের গঙ্গা আরতির মধ্য দিয়ে তাঁর ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন৷
প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য সহচর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে এ এক নতুন যুগের সূচনা৷ তিনি বলেছেন স্বাধীনতার পর মোদিজি ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত হিন্দু গৌরব ফিরিয়ে আনতে কেউ উদ্যোগ নেয়নি৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেই নতুন যুগের সূচনা করেছেন৷
ইতিমধ্যেই আরও একটি নির্বাচনে জয়লাভের মধ্যে দিয়ে সেদিনের ভাবী প্রধানমন্ত্রীর শাসনের আট বছর অতিক্রান্ত হয়েছে৷ শুধু সংসদ ভবন নয়, প্রায় সারা দেশটাই ইতিমধ্যে মন্দিরময় হয়ে উঠেছে৷ শুরু হয়ে গেছে নাকি নতুন যুগের।
রাজকোষের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে মন্দির নির্মাণের পেছনে৷ অত্যাধুনিক সেই সব নির্মাণ প্রকল্পের বৈভব, তার যাতায়াতের ঝাঁ চকচকে করিডর, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত নিরাপত্তারক্ষী সহ আনুষঙ্গিক আয়োজনে রাষ্ট্রের, শাসক এবং শাসক দলের পরাক্রম অত্যন্ত প্রকট৷ শুধু নতুন মন্দির নির্মাণ নয়, এ প্রকল্প তথাকথিত নতুন রাষ্ট্রবাদী হিন্দুত্ব নির্মাণেরও৷ সেই সব অসংখ্য মন্দির নির্মাণের মধ্যে গত দুই বছরের কয়েকটির অর্থ বরাদ্দ দেখলেই তা বোঝা যায়৷
উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির ৮৫০ কোটি টাকা, কালিকা মাতা মন্দির ১২৫ কোটি টাকা, কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ৭৫০ কোটি টাকা, অযোধ্যা ১৮০০ কোটি, গুজরাটের সূর্য মন্দির ৩৯০০ কোটি ইত্যাদি৷ এই বিপুল খরচের বাইরেও দেশের হিন্দু মন্দির পুনরুদ্ধার, পুনর্নির্মাণ রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও প্রতি বছরের ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে৷
শুধু দেশের মধ্যেই নয় বিদেশেও হিন্দু মন্দির নির্মাণে শত শত কোটি টাকা ঢালা হচ্ছে৷ হিন্দুত্বের ধবজা ওড়ানোর উদ্যোগে অঢেল টাকা ঢালা হচ্ছে বাহরিন আবুধাবি এমনকি পাকিস্তানেও৷ ভাবলে অবাক হতে হয়, এই এক একটি মন্দির নির্মাণের বিপুল অর্থে কত ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে অন্ন তুলে দেওয়া যেত৷ কত মানুষের অপুষ্টি দূর করা যেত, প্রাণ রক্ষা করা যেত বিনা চিকিৎসায় ধুঁকতে থাকা কত মানুষের। সেই কবে ক্ষুধার্ত মানুষের দেওয়া রাজস্বের টাকায় মন্দির নির্মাণ আর অর্থহীন ধর্মাচরণকে কষাঘাত করে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘কোটি টাকা খরচ করে কাশী বৃন্দাবনের ঠাকুর ঘরের দরজা খুলছে আর পডছে৷ এই ঠাকুর কাপড ছাডছেন, তো ওই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন, তো ওই ঠাকুর আটকুঁডির ব্যাটাদের গুষ্টির পিণ্ডি করছেন৷ এদিকে আসল ঠাকুর অন্ন বিনা বস্ত্র বিনা মরছে৷’ বিবেকানন্দই বলেছিলেন ‘ফার্স্ট ব্রেড অ্যান্ড দেন রিলিজিওন’৷ রাষ্ট্রবাদী হিন্দুত্ববাদীদের সংজ্ঞায় এই বিবেকানন্দ কি হিন্দু? মনে তো হয় না।
এ তো গেল কেন্দ্রীয় উদ্যোগ৷ ভোটের বাজারে এর সাফল্য দেখে রাজ্যে রাজ্যে সরকারগুলি ঝাঁপিয়ে পড়েছে একই কাজে৷ ‘নরম হিন্দুত্ব’ বা ‘গরম হিন্দুত্ব’– সংবাদমাধ্যমের বানানো নামের প্যাকেজিং যাই হোক, ধর্ম জাতপাত নিয়ে রাজনীতির আখের গোছানোর সুযোগ–সন্ধানে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের সাথে অ–বিজেপি রাজ্য কিংবা এমনকি পশ্চিমবঙ্গেরও কোনও প্রভেদ নেই৷ শোষণ–ত্যাচার থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে, তাঁদের নাগরিক অধিকারগুলি কেড়ে নিয়ে বা বঞ্চিত করে রেখে ও তাদের বন্ধু সেজে থাকতে ধর্মীয় উন্মাদনা জাতপাত ধর্ম–বর্ণকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যেকার বিভেদ ও অনৈক্যকে লালন পালন করা কেন্দ্র–রাজ্যের প্রতিটি শাসক দল শুধু নয়, সংসদীয় নির্বাচনসর্বস্ব প্রতিটি দলেরই আজ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁডিয়েছে৷
জনমনে ধর্মীয় কুসংস্কারের প্রভাব, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী মননের অভাব শাসকদের এই সুযোগ এনে দিয়েছে৷ কারণ নাগরিক অধিকার সম্বন্ধে জনগণের সচেতনতার সাথে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক৷
আমাদের দেশে বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীরা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে ভিত্তি করে নবজাগরণের তথা পার্থিব মানবতাবাদের চিন্তা তুলে ধরেছিলেন৷ সত্যিকার নবজাগরণের সেই চিন্তা তথা ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের চর্চা এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসকামী নেতৃত্ব কোনও দিনই চায়নি৷ জাতপাত ধর্ম–বর্ণ নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম এডিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিনিধি দক্ষিণপন্থী আপসকামী নেতৃত্ব৷ কারণ সামাজিক ক্ষেত্রে এই বৈপ্লবিক আন্দোলন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দিক থেকে তাঁদের ক্ষমতা লাভের অন্তরায় হবে এ আশঙ্কায় তাঁরা ছিলেন আতঙ্কিত৷ ক্ষুদিরাম, বিনয়, বাদল, দীনেশ, আসফাক–উল্লাহ খান, চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগৎ সিং থেকে শুরু করে সুভাষচন্দ্রের রাজনীতির সাথে আপসপন্থী গান্ধীবাদী নেতৃত্বের তীব্র বিরোধিতার কারণ নিহিত ছিল এখানেই৷ বলা বাহুল্য যে এ লড়াইতে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণপন্থীরা সক্ষম হয়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের এই দুর্বলতা স্বাধীন ভারতেও জাতপাত ধর্ম–বর্ণের বিভেদ, সাম্প্রদায়িকতার বীজ থেকে যাওয়ার অন্যতম কারণ৷
স্বাধীনতার পর থেকে বুর্জোয়া সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী স্বার্থে ধর্ম জাতপাতকে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করা, অন্য দিকে জনগণের অসচেতনতা– এ দুই–এর যোগফলেই সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রীয় হিন্দুত্ববাদ কিংবা মন্দির রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্র৷
তাদের রাজনীতির জয়ে উল্লসিত আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত একটি মন্দির উদ্ধোধন অনুষ্ঠানে বলেছেন, করোনা অতিমারির সময় গোটা বিশ্ব এই সংকটের উত্তর খুঁজেছে, কিন্তু কেউ পায়নি৷ এ পর্যন্ত দুনিয়ার দুটি বিশ্বব্যবস্থা (অর্থাৎ পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্র) ব্যর্থ হয়েছে৷ তৃতীয় কোনও বিকল্প আছে কি? তিনি বলেছেন, হ্যাঁ এই মন্দির নির্মাণ হল সেই বিকল্প পথের বার্তাকে দিক দিগন্তে ছডিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি৷ সেই প্রস্তুতি এখন তাদের বিপুল কর্মকাণ্ডে পরিণত৷
তাই তথাকথিত নতুন যুগের বার্তা ছড়িয়ে পডছে দিগ্বিদিকে৷ সাধারণ মানুষের অসহায়তার সুযোগে তাদের সরল ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে পাডায় পাডায় মহল্লায় মহল্লায় ছোট বড অসংখ্য মন্দির গডে উঠেছে৷ রাম, কালী, সন্তোষী, হনুমান, গণেশ আরও কত দেবতা৷ রাস্তার মোড়, একটুখানি ফাঁকা জায়গা, দরকার হলে রাস্তা দখল করেই চলছে মন্দির নির্মাণ৷ বুথে বুথে মন্দির কমিটি৷ শাসক বিরোধী সকলেই সেখানে প্রতিযোগিতায় মত্ত৷ ক্লাবগুলিও এখন মন্দির হয়ে উঠেছে৷ ছিটেফোঁটা উৎসাহ ভাতা মিলছে৷ ধর্ম আর ভক্তির হাত ধরে, মস্তানি, চাঁদার জুলুম, তোলা আদায়, সিন্ডিকেট, বাহুবলী রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত, তাকে কেন্দ্র করে দলাদলি মারামারি, বছরভর রাজনীতি৷ ‘নতুন যুগ’ গডে তোলার এক অভিনব সোসাল ইঞ্জিনিয়ারিং।
শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান প্রযুক্তিবিদ্যার গবেষণা কেন্দ্রেও মহাভারত গীতা বেদমন্ত্র পাঠ পঞ্চভূতের গবেষণা শুরু হয়েছে হইহই করে৷
এদিকে দেশে চূড়ান্ত বেকারি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি৷ শুধু তাই নয়, সংকট কৃষি শিল্প বাণিজ্য সহ অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রেই৷ এর সাথে শাসকদের চরম ভ্রষ্টাচার, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, সমস্ত মানুষের বিশেষ করে নারীর নিরাপত্তাহীনতা, শিশুমৃত্যু, ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যার ঘটনা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে৷ মানুষের চোখের জল, হাহাকার, প্রার্থনা কোনও কিছুতেই কোনও ঐশ্বরিক সুবিচারের দেখা মিলছে না৷
পৃথিবীব্যাপী পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই সংকট৷ কিন্তু ভারতের অবস্থা অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রায় সব থেকে খারাপ৷ ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যার নিরিখে তার স্থান পাকিস্তান বাংলাদেশ নেপাল শ্রীলঙ্কা এমনকি আফ্রিকার বেশ কিছু দেশের চেয়েও খারাপ৷ ১২১টি দেশের মধ্যে তার স্থান ১০৭ নম্বরে৷ শিশুমৃত্যুর হারে ভারত পৃথিবীর শীর্র্ষে৷ গত দুই বছরে কোভিড অতিমারির কারণে সারা বিশ্বে যত মানুষ রুজি রোজগার হারিয়ে গরিব হয়ে পডেছেন তার ৮০ শতাংশ ভারতীয়৷ মানবউন্নয়ন সূচকে ১৯১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৩২ তম৷ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য যখন সরকারি সহায়তা একান্ত প্রয়োজন তখন ক্রমাগত তেলের দাম, গ্যাসের দাম, রেলভাড়া বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উপর জিএসটি বসানো, সার বীজ কীটনাশকের মূল্যবৃদ্ধির মতো পদক্ষেপ করে সরকার নিঃস্ব মানুষকেই লুঠ করছে৷ আম্বানি–আদানিরা হয়ে উঠছেন সমাজের সমস্ত সম্পদের মালিক৷ সর্বাত্মক আক্রমণে মানুষ দিশাহারা৷ উদয়াস্ত পরিশ্রম নয়, সূর্যোদয় থেকে গভীর রাত্রি পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করেও জীবিকার সংস্থান করে ওঠা যাচ্ছে না৷
পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুড়িতে প্রবল পারদর্শী হলেও সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি শোষণ অত্যাচার ও প্রতারণার এই রাজনৈতিক প্রকরণটিকে পরিহার করার কথা ভাবতেই পারে না৷ জনগণকে তার নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার কাজ তাই তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির অঙ্গ নয়৷
গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে ভক্তি অন্ধবিশ্বাস, অন্ধ আনুগত্যের কোনও জায়গা নেই৷ তারা ভুলে বসে আছেন যে চিন্তায়, বৈষয়িক উৎপাদনে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, যুক্তিবাদ এবং ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতেই গণতন্ত্রের সৃষ্টি৷ গণতন্ত্রের শাসক কোনও রাজা বা সম্রাট নন৷ তিনি বিমূর্ত কোনও ঈশ্বরের নন, জনগণেরই প্রতিনিধি৷ সুনির্দিষ্ট কর্তব্য পালনে দায়বদ্ধও৷ সমস্ত নাগরিকের খাদ্য–বস্ত্র–বাসস্থান, সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য, জীবনের নিরাপত্তা এবং নাগরিক সম্মান প্রতিটি মানুষেরই প্রাপ্য৷ সে প্রাপ্য শাসকের প্রার্থনায় ঈশ্বরের দান হিসেবে ঝরে পডে না৷ শাসকের রোজগার, নিজস্ব সঞ্চয় কিংবা জন্মসূত্রে প্রাপ্ত পূর্বপুরুষের সম্পত্তি থেকেও তিনি তা বিলিবন্টন করেন না৷ জনগণের শারীরিক ও মানসিক শ্রমেই সে সমস্ত সম্পদ, তার উৎপাদনের উপকরণগুলির সৃষ্টি৷ সেই সমস্ত স্থায়ী–স্থায়ী সম্পদ সহ জ্ঞান–বিজ্ঞান প্রযুক্তির উপর নাগরিকদের অধিকারের ভিত্তিও সেটাই৷ সেই অধিকার বোধই তার আত্মমর্যাদার জায়গা৷ সেখানেই তো প্রজার সাথে নাগরিকের পার্থক্য৷ জনগণের এই সচেতনতার ভিত্তিতে নাগরিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগঠিত করতে গেলে বাস্তবে এই প্রতারণামূলক ব্যবস্থাটির স্বরূপ উন্মোচন করতে হবে৷ দাঁডাতে হবে তার বিরুদ্ধেই৷ ভোটবাজ দলগুলির নেতারা, তাঁরা শাসক বা বিরোধী যে আসনেই থাকুন, এই ব্যবস্থাকে পাল্টানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না৷ কারণ উভয়েই শাসক শ্রেণিরই প্রতিনিধি, এই ব্যবস্থাটির রক্ষক৷
এই সংসদীয় রাজনীতিতে তথাকথিত বিরোধীরাও কথায় কথায় বর্তমান শাসক দলের ফ্যাসিবাদী আচরণের কথা তোলেন৷ আচরণ যে ফ্যাসিবাদ সুলভ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দ্বারা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে পিষে মারা, পুঁজিবাদের ক্রমাগত সেবা করে অর্থনীতির চূডান্ত কেন্দ্রীকরণে সাহায্য করা, জনগণের ঘাডে সমস্ত রকমের শোষণ চাপিয়ে দেওয়া– এতে তাদের বিরাম নেই৷ মালিক শ্রেণি কলকারখানা চালানোর জন্য বিজ্ঞানের কারিগরি দিকটি ব্যবহার করলেও চিন্তা ভাবনায় ধর্মীয় গোঁডামি, কুসংস্কারের সব রকমের চর্চা ইত্যাদি এই ধরনের প্রতিটি পদক্ষেপই ফ্যাসিবাদের লক্ষণ৷ এগুলি আজ যে দল ক্ষমতায় আছে, থাকতে চায়, তারাই করে৷ কারণ পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থাটির স্বার্থ রক্ষা করতে হলে আজ জনবিরোধী বা ফ্যাসিবাদী এই পদক্ষেপগুলি না করে তাদের উপায় নেই৷ সে কারণেই প্রতারণা এবং অত্যাচার এদের প্রত্যেকের রাজনৈতিক প্রকরণ৷ ভোটের প্রচারে মুখে যাই বলা হোক, শাসক হিসেবে বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল বা রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতাসীন আঞ্চলিক দলগুলি এমনকি তথাকথিত বামপন্থী সিপিআই সিপিএম–-এই দিক থেকে সকলেই একই পথের পথিক৷
জনগণের এই তিক্ত উপলব্ধির কথা এইসব দলের নেতা–কর্মীরা কতটা বুঝতে পারছেন, কতটা জেগে ঘুমোচ্ছেন বা কতটা মোদির ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপের সমালোচনা করতে করতেই মোদিকে অনুকরণ করে মোদিরই বিকল্প হওয়ার চেষ্টা করছেন সেটা তাঁরাই সবচাইতে ভালো জানেন৷ তাঁরা ভাবেন রাজনীতি মানে জনগণকে বোকা বানানোর খেলা এবং সে খেলায় তাঁরাই কখনও জিতবেন কখনও হারবেন৷ আর চিরকাল এই শোষণমূলক নিষ্ঠুর ব্যবস্থার মহিমাময় মন্দিরটি অটুট থাকবে৷ কিন্তু তাঁরা ভাবেন বলেই তা ধ্রুব সত্য হয়ে উঠবে এ কথা মনে করার কোনও কারণ নেই৷ তাঁদের মনে করার দ্বারা ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারিত হয় না৷
জনগণ কোনও কিছুই ধরতে পারছে না, কিছুই বুঝতে পারছে না, প্রতিটি জুমলা অব্যর্থ ভাবে কাজ করছে মনে করে আপাতত তারা অত্যন্ত উল্লসিত৷ কিন্তু তাদের উল্লাস ও তৃপ্তি যাই হোক, সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার কঠোর সংগ্রাম কালক্রমে মানুষের কাছে অনেক কঠিন ও জটিল বিষয় স্পষ্ট ও সহজবোধ্য করে তোলে৷ তার লক্ষণও ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে বারবার৷ জনসাধারণের ক্ষোভ শাসকের বিরুদ্ধে যে পুঞ্জীভূত বিস্ফোরণের আকার নিচ্ছে তার প্রকাশ ঘটছে মাঝেমাঝেই৷ আতঙ্কিত শাসক শ্রেণি দমননীতি নামিয়ে আনছে মানুষের স্বাধীন মত প্রকাশে, নাগরিক অধিকারে, সাংবাদিকের স্বাধীনতায়৷ কিন্তু জীবন ও জীবিকার তাগিদে হাজার দমন পীড়ন অত্যাচার সত্ত্বেও মানুষকেই নামতে হয় প্রাণপণ লড়াইতে৷ ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের পক্ষে জনগণের এই যন্ত্রণা কিংবা লড়াইতে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়৷ কারণ তথাকথিত এই বিরোধীদের ভোটসর্বস্ব রাজনীতি একই রকম ভাবে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষারই রাজনীতি৷ জনগণকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের ভোট আদায় করে পুঁজিপতি শ্রেণির সেবা করাই এই রাজনীতির মূল চরিত্র৷ তাই শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন সহ সমস্ত অত্যাচার শোষণের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদবিরোধী যথার্থ গণআন্দোলনের শক্তিই জনগণের লড়াই ও সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে পারে৷