প্রধানমন্ত্রী কথিত স্বাধীনতার অমৃতকালের ভোর হওয়ার আগেই ১৪ আগস্ট শেষনিঃশ্বাস ফেলে বিদায় নিয়েছে রাজস্থানের স্কুল ছাত্র ৯ বছরের ইন্দ্র মেঘওয়াল। তথাকথিত ‘নিচু’ জাতের ছেলে হয়েও স্কুলে ‘উঁচু’ জাতের জন্য রাখা জলের কলসি ছুঁয়ে ফেলার অপরাধে ‘উচ্চবর্ণের’ শিক্ষকের মারে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে।
১৬ আগস্ট উত্তরপ্রদেশে স্কুলের ২৫০ টাকা ফি দিতে না পারায় ‘উচ্চবর্ণের’ শিক্ষকের মারে প্রাণ হারিয়েছে তথাকথিত ‘নিচু’ জাতভুক্ত ১৩ বছরের ব্রিজেশ কুমার। এমন ঘটনার শেষ নেই ভারতে। উত্তরপ্রদেশের হাথরস, লখিমপুর, খেরি, গুজরাটের উনা, হরিয়ানার হিসার, কর্ণাটকের শান্তিপুরা সহ ভারতের নানা জায়গায় কখনও তথাকথিত উচ্চবর্ণের ক্ষমতাশালীদের হাতে, কখনও বিজেপি-আরএসএস এবং তাদের ঘনিষ্ঠ বজরঙ দলের মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নিগৃহীত এমনকি নিহত হচ্ছেন দলিত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। অথচ ঠিক এই সময়েই আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হলেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল বিজেপি প্রচার করছে একজন আদিবাসী জনজাতিভুক্ত মানুষের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়া একটা ঐতিহাসিক ঘটনা।
কিন্তু এটা বিশেষ এবং ব্যতিক্রমী ঘটনা কেন? দ্রৌপদী মুর্মু একজন ভারতীয় নাগরিক, স্বচ্ছল পরিবারে জন্মের সুবাদে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন, বিজেপির প্রতিনিধি হিসাবে কাউন্সিলর থেকে এমএলএ এমনকি রাজ্যপাল হওয়ার অভিজ্ঞতাও তাঁর আছে। বর্তমানে তাঁর দল বিজেপির সাংসদ ও এমএলএ মিলিয়ে যা সংখ্যা তাতে তাঁর রাষ্ট্রপতি পদে এই জয় খুব স্বাভাবিক। তা হলে এই ঘটনা ব্যতিক্রমী কেন? তিনি আদিবাসী পরিবারের সন্তান বলেই কি? অর্থাৎ স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর ধরে এ দেশের নানা রঙের সরকারি দলগুলি যে শাসন চালিয়েছে, তাতে একজন আদিবাসী জনজাতিভুক্ত মানুষের উচ্চপদে নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টা আজও ব্যতিক্রমী ঘটনা হয়েই আছে! সে জন্যই বোধহয় প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল বিজেপি প্রচার করছে, দেখ, আমাদের বদান্যতায় একজন আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতি হতে পারলেন! কিন্তু এ জন্য তাঁদের বিশেষ বদান্যতার প্রয়োজন হল কেন? এই প্রচারই তো প্রমাণ করে দেয় আদিবাসী মূলবাসী জনজাতিভুক্ত মানুষের উচ্চপদে আসীন হওয়ার বিষয়টিকে শাসকরা কোন চোখে দেখে!
প্রচার করা হচ্ছে, দ্রৌপদীজি রাষ্ট্রপতির আসনে বসায় এ দেশের অবহেলিত বঞ্চিত আদিবাসী জনগণ বিকাশের শক্তি লাভ করলেন। পাঁচ বছর আগে যেমন বিজেপি প্রচার করেছিল, রামনাথ কোবিন্দ রাষ্ট্রপতি হওয়ায় দলিতদের প্রতি বঞ্চনা দূর হয়ে যাবে। অথচ বাস্তব তথ্য বলছে বিজেপি শাসনেই দলিত এবং আদিবাসী জনগণের উপর আক্রমণ, তাদের অবমাননা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। শুধু ২০২০-তেই দলিতদের উপর অত্যাচার এবং অবমাননার ৫০ হাজারের বেশি অভিযোগের কোনও বিচার হয়নি। ২০১১-‘২০ এই ১০ বছরে আদিবাসীদের উপর হামলার ৭৬ হাজার ৮৯৯টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোতে। তথাকথিত উচ্চবর্ণ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের সমর্থক বিজেপি-আরএসএস-এর আদর্শ বলে, ব্রাহ্মণরাই শ্রেষ্ঠ, শূদ্রের জন্মই উচ্চবর্ণের সেবার জন্য। তাদের এই সেবক তালিকায় যেমন দলিতরা আছেন, তেমনই আদিবাসী সম্প্রদায়ও আছেন। আরএসএস শুরু থেকেই বর্ণহিন্দুদের শ্রেষ্ঠ বলে মেনেছে। তাদের গুরুজি গোলওয়ালকর চেয়েছিলেন মনুসংহিতাকেই ভারতের সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করতে। মনুসংহিতার বিধান হল, শূদ্রের জন্মইউচ্চবর্ণের সেবার জন্য। সেই বিধানকে মানলে গোলওয়ালকারের শিষ্য আরএসএস-বিজেপি, দলিত এবং আদিবাসীদের কোন মর্যাদা দেবে? আদিবাসী সমাজ বহু যুগ ধরে প্রকৃতির উপাসনাকেই স্বাভাবিক ধর্ম হিসাবে মেনে এসেছে। কোনও হিন্দু দেবদেবীর উপাসনার চল তাদের মধ্যে নেই। ‘সারনা’ ধর্মের জন্ম এখান থেকেই। পরবর্তীকালে উচ্চবর্ণের ঘৃণা ও অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে তাদের অনেকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন। আরএসএস-এর বিধান হল এদের সকলকেই হিন্দু উপাসনার রীতিতে ফিরতে হবে। বিজেপি সেই বিধানকে মেনে চলে। যে কারণে আরএসএস-বিজেপি বহু রাজ্যে আদিবাসীদের হিন্দুত্বের পাঠ দেওয়ার শিবির করছে। এই পথ ধরেই বজরঙ দলের মতো বিজেপি ঘনিষ্ঠ নানা শক্তি বারে বারে আদিবাসীদের উপাসনাস্থল এবং গির্জার উপর হামলা চালিয়েছে। এর পরেও বিজেপির হাতে আদিবাসী জনগণের সংস্কৃতি, ভাষা, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রক্ষিত হতে পারে?
বিজেপি মনোনীত রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর ইতিহাসও বলে, আদিবাসী ঘরে জন্ম হলেও তিনি কোনও দিন আদিবাসী, দলিত, জনজাতিদের অধিকার রক্ষায় একটি শব্দও ব্যয় করেননি। তিনি বিজেপির টিকিটে কাউন্সিলর, এমএলএ, ওড়িশা রাজ্যের মন্ত্রী এবং ঝাড়খণ্ডের মতো আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যের রাজ্যপাল হয়েছেন। কিন্তু সরকার জঙ্গল-কৃষিজমি থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদের চেষ্টা যখনই করেছে তিনি হয় নীরব দর্শক অথবা তার সমর্থক হয়ে থেকেছেন। তিনি ময়ূরভঞ্জ জেলার রাইরাঙপুরে বিজেপির কাউন্সিলর থাকাকালীন ওই জেলায় খনি মাফিয়ারা আদিবাসীদের জমি দখল করে আদিবাসী শ্রমিকদের উপর অত্যাচার, গুমখুন চালিয়েছে। তিনি কোনও দিন প্রতিবাদ করেছেন বলে কারও জানা নেই। ২০০২ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার আদিবাসীদের জঙ্গলের অধিকার কেড়ে নেওয়ার আইন করলে তিনি ছিলেন তার সমর্থক। তিনি মন্ত্রী থাকাকালীনই ওড়িশায় বিজেপি-বিজেডি জোট সরকার কলিঙ্গনগরে আদিবাসীদের জমি, জঙ্গল টাটা কোম্পানির স্বার্থে জোর করে অধিগ্রহণ শুরু করে। প্রতিরোধ আন্দোলনে ২০০৬-এর জানুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে ১৩ জন আদিবাসী মানুষ প্রাণ হারান। পরে বিজেপি জোট সরকার এই হত্যার জন্য পুলিশের প্রশংসা করে। দ্রৌপদীজি এর বিরুদ্ধে কখনও মুখ খুলেছেন? তিনি ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল থাকাকালীন বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকার ছোটনাগপুর টেনেন্সি অ্যাক্ট এবং সাঁওতাল পরগণা টেনেন্সি অ্যাক্টকে দুর্বল করে দিয়ে আদিবাসীদের জমি যথেচ্ছ ভাবে কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠলে ১০ হাজার আদিবাসীর উপর রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মারাত্মক অভিযোগ আনে বিজেপি সরকার। পরবর্তীকালে আন্দোলনের চাপে এই আইন নিয়ে বিজেপি আর এগোতে সাহস করেনি। ফলে তাঁকেও সে আইনে আর সই করতে হয়নি। দ্রৌপদীজির ভূমিকা এক্ষেত্রেও ছিল সরকারের অনুগত সৈনিকের মতোই। সম্প্রতি বিজেপি সরকার জঙ্গলের অধিকার আইন ২০০৬-কে দুর্বল করে দিয়ে জঙ্গলের জমি শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার আগে সেখানে বসবাসকারী আদিবাসী, মূলবাসী, জনজাতিদের মতামত নেওয়ার শর্ত বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে লক্ষ লক্ষ পরিবার যারা বনজ সম্পদের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে, তারা বিপদগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্রপতির আসন থেকে এই চরম অন্যায়ের প্রতিবাদ ধ্বনিত হওয়ার আশা কি কেউ করতে পারবেন?
পাঁচ বছর আগে রামনাথ কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসানোর সময় তাঁর দলিত পরিচয়কে তুলে ধরে দলিত স্বার্থের চ্যাম্পিয়ন সেজেছিল বিজেপি। তাতে দলিতদের কী উপকার হয়েছে? এই সময়কালেই কেন্দ্রীয় সরকারের মদতে দলিতদের সুরক্ষা আইনকে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তাঁর সময়কালেই উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশে দলিত নির্যাতন বেড়েছে। উত্তরপ্রদেশের হাথরসে দলিত কন্যাকে ধর্ষণ করে হত্যার মর্মান্তিক ঘটনার পর বিচার দূরে থাক বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকারের পুলিশ ব্যস্ত থেকেছে রাতের অন্ধকারে তার দেহকে পুড়িয়ে প্রমাণ লোপাট করে দেওয়ার কাজে। বিজেপি রাজত্ব দলিতদের উপর অত্যাচারের অন্যতম কালো অধ্যায় হয়ে আছে। রামনাথ কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে খাড়া করে রেখে বিজেপি সরকার সুপ্রিম কোর্টকে হাতিয়ার করে ‘তফসিলি জাতি-উপজাতি নিগ্রহ প্রতিরোধ আইন’ দুর্বল করার চেষ্টা করেছে। দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ তার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামলে ২০১৮-র ২ এপ্রিল পুলিশ গুলি করে ১১ জনকে হত্যা করে। ওই বছরই তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হংসরাজ গঙ্গারাম আহির রাজ্যসভায় তথ্য দিয়ে জানিয়েছিলেন, এই আইনে নথিভুক্ত বেশিরভাগ মামলার বিচার আদৌ শুরুই হয়নি। রাষ্ট্রপতির আসন থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া কিন্তু মেলেনি।
ভারত সরকারের সর্বশেষ হাউসহোল্ড সার্ভে জানাচ্ছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৪০.৬ শতাংশ দারিদ্রসীমার নীচে। ৪২ শতাংশ আদিবাসী শিশু অপুষ্টির শিকার, শিশুমৃত্যুতে সমস্ত সম্প্রদায়ের তুলনায় আদিবাসীদের হার বেশি। মেঘালয়ের মতো রাজ্যে ৭৬ শতাংশ আদিবাসী শিশু অপুষ্ট। টিবি, ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সর্বাধিক। বিগত ১০ বছরে অর্থাৎ মূলত বিজেপি শাসনে মোট আদিবাসী জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই তাঁদের স্বাভাবিক বসবাসের স্থান থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন।
ভারতের মতো একটা শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, যা ইতিমধ্যেই সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জন করেছে, তেমন একটি রাষ্ট্রের উচ্চাসনে কোনও বিশেষ সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠীভুক্ত কাউকে বসিয়ে দিলেই কি সেই সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠীর উন্নতি হতে পারে, না হওয়া সম্ভব? পুঁজিবাদী শাসনে খেটে খাওয়া সমস্ত অংশের মানুষই শোষিত-নিপীড়িত। এর মধ্যেও দীর্ঘদিন সামাজিক বঞ্চনা ও শোষণের শিকার আদিবাসী, দলিত, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বড় অংশের দরিদ্র মানুষ যে তীব্রতায় শোষণ-যন্তে্রর নিপীড়ন ভোগ করেন তা আরও মারাত্মক। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে এমনিতেই আধিপত্যকারী গোষ্ঠী দুর্বলদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তথাকথিত উচ্চবর্ণের যে অংশ অপেক্ষাকৃত অধিকতর সম্পদের মালিক হয়ে বসে আছে, তাদের দাপটে স্বাধীন ভারতেও ভাষাগত, সম্প্রদায়গত-জাতিগতভাবে অপেক্ষকৃত দুর্বল গোষ্ঠীর মানুষ সঙ্কুচিত হয়ে থাকেন। এ দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যেও তথাকথিত উচ্চবর্ণজাত হিন্দুদের প্রতিপত্তির প্রভাব অন্যদের দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। স্বাধীনতার পর কংগ্রেস নেতাদের অধিকাংশই এই তথাকথিত উচ্চবর্ণের শ্রেষ্ঠত্ব এবং আধিপত্যের অধিকারের ধারণায় আচ্ছন্ন ছিলেন। কংগ্রেসের এই দুর্বলতাই বিজেপি-আরএসএসের উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থানের জমি তৈরি করে দিয়েছে। অন্যদিকে দলিত এবং আদিবাসী অধিকারের ধুয়ো তুলে একদল ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। তাঁরা শোষিত মানুষের সামগ্রিক ঐক্যের কথা না বলে দলিত, সংখ্যালঘু আদিবাসী অধিকারের চ্যাম্পিয়ন সেজেছেন। দলিত এবং আদিবাসীদের জন্য যে সমস্ত সুবিধার কথা শাসকদলগুলি প্রচার করে থাকে, তার ফলে খুব বেশি হলে এই অংশের মানুষের ৩ শতাংশ লাভবান হয়েছেন। যারা সুযোগ পেয়েছে তারাই পরম্পরাগতভাবে সুবিধা ভোগ করে চলেছে। এই সুবিধাভোগী অংশের কিছু মানুষকে শাসক শ্রেণি কাজে লাগায় অধিকাংশ বঞ্চিত, দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষকে দাবিয়ে রাখতে। এরা কেউ কেউ মন্ত্রী হন, এমনকি মুখ্যমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিও হতে পারেন, কিন্তু তাতে শোষিত আদিবাসী, দলিত, অন্যান্য অংশের খেটে খাওয়া মানুষের উপকার হওয়া দূরে থাক, এই সুবিধাভোগীরা পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস হয়ে নির্মম শোষণ চালানোর হাতিয়ারে পরিণত হন। এর ফলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত খেটে খাওয়া নিপীড়িত মানুষের ঐক্যের সম্ভাবনায় চিড় ধরে।
দলিত-আদিবাসী জনগণের এই যে দুটি মূল সমস্যা–একদিকে পুঁজিবাদী শোষণ, অন্যদিকে উচ্চজাতিসমূহের আধিপত্য–কোনও দলিত-আদিবাসী ব্যক্তিকে পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে বসিয়ে দিলেই তা কোনও মতে দূর হতে পারে না। এর জন্য জরুরি শোষণমূলক সমাজব্যবস্থাটির অবসান এবং সমাজের গণতন্ত্রীকরণ, জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ঊর্ধ্বে মানসিকতার উত্তোলন।
ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সমাজের গণতন্ত্রীকরণের এই কাজটি মুখ থুবড়ে পড়েছে আপসকামী নেতৃত্বের প্রাধান্যের কারণে। আজ স্বাধীন ভারতে এই কাজটি ব্যাহত করছে সংসদসীয় বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া এবং সংসদীয় বাম দলগুলিও। পুঁজিপতিশ্রেণি চায় জনগণের ঐক্য ধ্বংস করার জন্য এই ধরনের জাত-পাতগত সমস্যা জিইয়ে রাখতে, খুঁচিয়ে তুলতে। ফলে এদেরই স্বার্থরক্ষক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই সমস্যাগুলি সমাধানের কোনও উদ্যোগই নেয় না, নিতে পারে না। আজ জাতিগত বিভেদের, আধিপত্যের এই সমস্যাগুলি দূর করার সংগ্রামটি ঐতিহাসিক ভাবে শোষণ-বঞ্চনাবিরোধী, পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রামের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। দলিত, আদিবাসী সহ সমস্ত স্তরের খেটেখাওয়া মানুষকে এই সত্য বুঝতেই হবে–আজ নূ্যনতম অধিকার, সংস্কৃতি, ভাষা, সাংস্কৃতিক সামাজিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে হলেও প্রয়োজন শোষিত সকল মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। এর মধ্য দিয়েই একদিকে গণতান্ত্রিক দাবিগুলি শক্তিশালী হবে, অন্যদিকে সকল মানুষের অবাধ বিকাশের উপযোগী নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজের জন্য লড়াইয়ের শক্তি এর থেকেই অর্জিত হবে।