রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ১০৪তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে মহান লেনিনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ থেকে একটি অংশ আমরা প্রকাশ করলাম। রচনাটি রাষ্ট্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা গড়ে তুলতে সহায়তা করবে ভেবেই আমাদের এই প্রচেষ্টা।
বর্তমানে মার্কসের মতবাদের ক্ষেত্রে যা ঘটছে, মুক্তিসংগ্রামরত নিপীড়িত শ্রেণিগুলির অন্যান্য চিন্তানায়ক ও নেতাদের মতবাদের ক্ষেত্রেও ইতিহাসের গতিপথে প্রায়শ তা-ই ঘটেছে। মহান বিপ্লবীদের জীবদ্দশায় উৎপীড়ক শ্রেণিগুলি লাগাতার তাঁদের তাড়া করে বেড়ায়, তাঁদের শিক্ষার প্রতি বিদ্বেষ-দুষ্ট বৈরিতা ও হিংস্র ঘৃণা প্রকাশ করে এবং নির্বিচারে সে-সবের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও কুৎসার অভিযান চালায়। মৃত্যুর পরে এইসব বিপ্লবীকে নিরীহ দেব-বিগ্রহে পরিণত করার, সাধু সিদ্ধপুরুষ রূপে গণ্য করার চেষ্টা হয়ে থাকে। নিপীড়িত শ্রেণিগুলির ‘সান্ত্বনা’র জন্য এবং তাদের প্রতারণার উদ্দেশ্যে এই সব বিপ্লবীর নামের সঙ্গে একটা জৌলুস জুড়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে তাঁদের বৈপ্লবিক মতবাদের মর্মবস্তুকে ছেঁটে দিয়ে তাকে নিবীর্য খেলো করা হয়, তার বৈপ্লবিক তীক্ষ্নতাকে ভোঁতা করে দেওয়া হয়। বর্তমান সময়ে বুর্জোয়ারা এবং শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যেকার সুবিধাবাদীরা মার্কসবাদ ‘সংশোধনে’র কাজে পরস্পর সহযোগিতা করে চলেছে। তারা মার্কসীয় শিক্ষার বৈপ্লবিক মর্মকেই বর্জন করে, ধোঁয়াটে করে তোলে ও বিকৃত করে। বুর্জোয়া শ্রেণির কাছে যে অংশটুকু গ্রহণযোগ্য হতে পারে বলে মনে হয়, ততটুকুই মাত্র এরা সামনে নিয়ে আসে ও জোর গলায় তার প্রশংসা করে। সব উগ্র জাতীয়তাবাদীই আজকাল ‘মার্কসবাদী’ (হাসবেন না)। জার্মানির বুর্জোয়া পণ্ডিতরা, যাঁরা মাত্র গতকালও মার্কসবাদ খতমের কাজে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, তাঁরাই আজ ‘জাতীয়-জার্মান’ মার্কসের কথা ঘন ঘন বলছেন। আর, যে মজুর-ইউনিয়নগুলিকে পররাজ্যগ্রাসী যুদ্ধের পক্ষে এমন চমৎকার সংগঠিত দেখা যাচ্ছে, তাঁদের মতে, মার্কসই নাকি সেই মজুর-ইউনিয়নগুলিকে শিক্ষিত করে তুলেছেন!
এরকম অবস্থায় যখন ব্যাপকভাবে মার্কসবাদের বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে, তখন রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসের প্রকৃত শিক্ষা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই আমাদের প্রধান কর্তব্য। এই জন্য মার্কস ও এঙ্গেলসের রচনা থেকে বহু দীর্ঘ উদ্ধৃতির প্রয়োজন হবে। অবশ্য দীর্ঘ উদ্ধৃতির ফলে গ্রন্থ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে এবং সবার পক্ষে সহজপাঠ্য হবে না। কিন্তু তবুও দীর্ঘ উদ্ধৃতি বাদ দেওয়াও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভাবকদের সমগ্র মতামত ও সেই মতামতের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে পাঠক যাতে স্বাধীনভাবে একটা ধারণা গঠন করতে পারেন এবং বর্তমানে কাউটস্কিপন্থীদের হাতে সেই-সব মতামতের যে বিকৃতি ঘটে চলেছে মার্কস-এঙ্গেলসের লেখা থেকেই তা যাতে সর্বসমক্ষে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, সেই জন্য তাঁদের রচনায় রাষ্ট্রের কথা যেখানে আছে সেই সমস্ত অংশই, অন্তত সবচেয়ে অপরিহার্য অংশগুলি যথাসম্ভব পুরাপুরি অবশ্যই উদ্ধৃত করতে হবে।
‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ নামক এঙ্গেলসের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থ নিয়েই শুরু করা যাক। ১৮৯৪ সালে স্টুটগার্টে এই গ্রন্থের ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মূল জার্মান গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত অংশ আমাদের অনুবাদ করে নিতে হবে। কারণ, রুশ ভাষায় এই গ্রন্থের অনেক অনুবাদ থাকলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেসব অনুবাদ অসম্পূর্ণ, অথবা আদৌ সন্তোষজনক নয়।
এঙ্গেলস তাঁর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মূল কথা বলতে গিয়ে বলেছেনঃ ‘‘…রাষ্ট্র কোনও ক্রমেই বাইরে থেকে সমাজের উপর আরোপিত একটি শক্তি নয়। হেগেল বলতেন, ‘রাষ্ট্র নৈতিক বোধের বাস্তব রূপ’, রাষ্ট্র ‘যুক্তির প্রতিমূর্তি ও বাস্তব রূপ’; কিন্তু রাষ্ট্র তেমন কিছু নয়, বরং সমাজের বিকাশের বিশেষ একটি স্তরেই রাষ্টে্রর উদ্ভব। সমাজে রাষ্টে্রর উদ্ভব হয়েছে মানেই সমাজ সমাধানের অতীত একটা স্ববিরোধিতার জালে জড়িয়ে পড়েছে। এর অর্থ, মীমাংসার অতীত এক দ্বন্দে্ব সমাজ দীর্ণ, যে দ্বন্দ্ব মীমাংসায় সমাজ অক্ষম। বিভিন্ন শ্রেণি, যাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ পরস্পরবিরোধী, তারাই হচ্ছে সমাজের এই অর্ন্তদ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বরত শ্রেণিগুলি যাতে নিষ্ফল সংগ্রামে নিজেদের ও গোটা সমাজকেই ধ্বংস করে ফেলতে না পারে, তারই জন্য এমন একটি শক্তির প্রয়োজন ঘটে যাকে আপাতদৃষ্টিতে সমাজের ঊর্ধ্বে অবস্থিত বলে মনে হয়– শ্রেণি-সংঘাত প্রশমিত করে ‘শৃঙ্খলা’র গণ্ডির মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ করে রাখাই হল যার উদ্দেশ্য। এই শক্তি, যা সমাজ থেকে উদ্ভূত হয়েও নিজেকে সমাজের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে এবং ক্রমাগত সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়, তা হচ্ছে রাষ্ট্র।” (পৃষ্ঠা ১৭৭-৭৮ ষষ্ঠ জার্মান সংস্করণ)।
রাষ্ট্রের অর্থ ও ঐতিহাসিক ভূমিকা কী, সে সম্পর্কে মার্কসীয় তত্তে্বর মূল ধারণা ঊদ্ধৃত অংশের মধ্যে স্পষ্ট ও যথাযথভাবে প্রকাশ পেয়েছে। রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণিবিরোধের অনিরসনীয়তার ফল ও অভিব্যক্তি। যখন যেখানে ও যে অনুপাতে শ্রেণি বিরোধ বাস্তবে সমাধান করতে পারা যায় না, তখন সেই অবস্থায় সেই অনুপাতে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। অপর দিক থেকে এটাও বলা চলে, রাষ্ট্রের অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে, শ্রেণিবিরোধ মীমাংসার অতীত।
ঠিক এই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল বিষয়টির ব্যাপারেই মার্কসবাদকে বিকৃত করা হয়। বিকৃত করা হয় প্রধানত দুই দিক থেকে।
একদিকে, বুর্জোয়া তাত্ত্বিক এবং বিশেষ করে পেটি-বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা– যেখানে শ্রেণি-বিরোধ ও শ্রেণি-সংগ্রাম আছে কেবল সেখানেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিদ্যমান– অবিসংবাদিত ও ঐতিহাসিক তথ্যের চাপে এটা স্বীকার করতে বাধ্য হলেও, তারা মার্কসকে এমনভাবে ‘সংশোধন’ করে যাতে মনে হবে যে রাষ্ট্র হল বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে আপস-মীমাংসা ঘটাবার একটা যন্ত্র বিশেষ। মার্কসের মতে, বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে আপস-মীমাংসা যদি সম্ভবই হত, তা হলে রাষ্ট্রের উদ্ভবই হত না, রাষ্ট্র স্বকীয় অস্তিত্বই বজায় রাখতে পারত না। কিন্তু পেটি-বুর্জোয়া এবং সঙ্কীর্ণমনা অধ্যাপক ও প্রচারকদের মতে, রাষ্ট্রশক্তি বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে আপস-নিষ্পত্তি ঘটায়– তাঁরা মাঝে মাঝেই উদারমনা সেজে মার্কসের উক্তির দোহাই পেড়ে তাঁদের এই মত জাহির করেন। মার্কসের মতে, রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণি-শাসনের যন্ত্র, এক শ্রেণি কর্তৃক অপর শ্রেণিকে পীড়ন করবার যন্ত্র। এ হল ‘শৃঙ্খলা’র ফল যা শ্রেণিবিরোধকে সীমার মধ্যে রেখে এই পীড়নকে আইনসঙ্গত করে ও স্থায়িত্ব দেয়। কিন্তু পেটি-বুর্জোয়া রাজনীতিকদের মতে শৃঙ্খলার অর্থ, বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে আপস-নিষ্পত্তি, এক শ্রেণি কর্তৃক অপর শ্রেণিকে পীড়ন করা নয়। তাদের মতে, শ্রেণি-সংঘর্ষ প্রশমিত করার অর্থ, শ্রেণিগুলির মধ্যে সমন্বয় ঘটানো, উৎপীড়কদের উৎখাত করার সংগ্রামের নির্দিষ্ট উপায় ও পদ্ধতি থেকে নিপীড়িত শ্রেণিগুলিকে বঞ্চিত করা নয়।
উদাহরণ স্বরূপ, ১৯১৭ সালের বিপ্লবে যখন রাষ্ট্রের তাৎপর্য ও ভূমিকার প্রশ্নটি একটি বাস্তব প্রশ্ন হিসাবে পূর্ণ গুরুত্ব নিয়ে দেখা দিল এবং ব্যাপক ভিত্তিতে সেই প্রশ্নের আশু মীমাংসার প্রয়োজনও দেখা দিল, তখন সঙ্গে সঙ্গেই, সোসালিস্ট-রেভোলিউশনারিরা ও মেনশেভিকরা সকলেই সেই পেটি-বুর্জোয়া তত্ত্বে নেমে এল যে, ‘রাষ্ট্র’ শ্রেণিগুলির মধ্যে ‘সমন্বয়’ ঘটায়। এই দুই দলের রাজনীতিকদের অসংখ্য প্রস্তাব ও নিবন্ধ এই পেটি-বুর্জোয়া এবং সঙ্কীর্ণমনা ‘সমন্বয়’-এর তত্ত্বে ঠাসা। রাষ্ট্র যে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির শাসন-যন্ত্র, যার সঙ্গে তার প্রতিপক্ষের (তার বিরুদ্ধ শ্রেণির) সমন্বয় ঘটানো সম্ভব নয়– এ বিষয়টি পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা কখনই বুঝতে পারবে না। আমাদের সোসালিস্ট-রেভোলিউশনারি ও মেনশেভিকরা যে আদপেই সোসালিস্ট নয় (আমরা, বলশেভিকরা যে কথা সবসময় বলে এসেছি), সমাজতন্ত্র-ঘেঁষা বুলি-আওড়ানো পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রী মাত্র, তার অন্যতম জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ হচ্ছে রাষ্ট্র সম্বন্ধে তাদের এই ধারণা।
অন্য দিকে ‘কাউটস্কিপন্থীরা’ যেভাবে মার্কসকে বিকৃত করে, তা আরও সূক্ষ্ম ধরনের। ‘তত্ত্বের দিক থেকে’ তারা এ কথা অস্বীকার করে না যে, রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণি-শাসনের যন্ত্র এবং বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ আপসে মীমাংসা করা যায় না। কিন্তু যে বিষয়টি তারা উপেক্ষা করে বা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করে, তা হল এই– মীমাংসার অতীত যে শ্রেণি-বিরোধ, তারই ফলে যদি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়ে থাকে, রাষ্ট্র যদি সমাজের ঊর্ধ্বে অবস্থিত এক শক্তি হয় যে শক্তি ‘সমাজ থেকে নিজেকে ক্রমশই বিচ্ছিন্ন করে নিচ্ছে’, তা হলে স্পষ্টতই বোঝা যায়, একটা সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া নিপীড়িত শ্রেণির মুক্তিলাভ সম্ভব নয়।
শুধু তাই নয়– শাসক শ্রেণি রাষ্ট্রশক্তির যে যন্ত্র তৈরি করেছে এবং যার মধ্যে এই ‘সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা’ মূর্ত রূপ নিয়েছে, সেই রাষ্ট্রযন্তে্রর ধ্বংস ছাড়াও নিপীড়িত শ্রেণির মুক্তি সম্ভব নয়। আমরা পরে দেখব, বিপ্লবের করণীয় কাজের সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের গুরুত্ব সম্পর্কে মার্কস দ্ব্যর্থহীনভাবে এই তত্ত্বগত স্বতঃপ্রমাণিত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। এবং এর পরে আমরা বিস্তারিত ভাবে দেখাব যে, কাউটস্কি ঠিক এই সিদ্ধান্তটিই ‘ভুলে গেছেন’ এবং বিকৃত করেছেন।