ভারতের মানুষ তেল-গ্যাস কিনছেন চড়া দামে, অথচ ভারত থেকেই তেল বিদেশে যাচ্ছে অনেক সস্তায়! দেশপ্রেমের চ্যাম্পিয়ন নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বে এমন কাজ কী করে সম্ভব! তিনি কি এ খবর জানেন না, নাকি এ ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথিত ‘নীলকণ্ঠ’ হয়ে একচেটিয়া মুনাফাখোরদের সব বিষ নিজের গলায় পুরে তাদের আড়াল করে বসে আছেন? সত্যটা কী?
বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধিকে অজুহাত করে ভারতে পেট্রোপণ্যের দাম প্রায় প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। মাঝে কয়েক দিন একটু বিরতি পড়তেই কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী তেল কোম্পানিগুলির জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে বলেছেন, তেলের দাম না বাড়ানোয় তাদের প্রতিদিন প্রচুর লোকসান করছে। তেলের আকাশছোঁয়া দামের ইন্ধনে যে মূল্যবৃদ্ধির আগুন আরও দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে তা কেন্দ্রীয় সরকারের ধামাধরা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তাদেরও মানতে হচ্ছে। সে আগুনের জ্বালায় বিক্ষুব্ধ জনগণ যাতে আন্দোলনের পথ না নেয় তার জন্যতাদের সইয়ে নেওয়ার সুযোগ দিতেই মাঝে মাঝে তেলের দামবৃদ্ধিতে বিরতি দিয়েছে সরকার। লোক দেখানো পদক্ষেপ হিসাবে তেলে সামান্য কিছু কর ও সেস ছাড়ও দিয়েছে তারা। এখন দাম বৃদ্ধির দায় ঘাড় থেকে নামাতে তরজা চলছে, কে তেলের দাম বাড়ানোর জন্য বেশি দায়ী, কেন্দ্র না রাজ্য।
পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী জানিয়েছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলি নাকি পেট্রলে লিটারে ২০ টাকা ও ডিজেলে ১৭ টাকা ক্ষতি করে জনগণকে তেল দিচ্ছে। আহা, এমন ব্যাপার যদি সত্যিই ঘটত! কিন্তু তথ্য যে অন্য কথা বলছে! ক্ষতির বদলে তেল কোম্পানিগুলো মুনাফা করেছে বিপুল। ২০২১-২২-এর আর্থিক বছরে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ নিট মুনাফা করছে ৬৭ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা, একইভাবে সরকারি কোম্পানি ওএনজিসির মুনাফা ৪০ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা, যা সংস্থার সর্বকালের রেকর্ড। ইন্ডিয়ান অয়েলের মুনাফা ২৪ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা, অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের মুনাফা এক বছরে দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ৩৮৮৭ কোটি টাকা। এই কোম্পানি আগের বছর এক ব্যারেল তেল থেকে আয় করেছিল ৫৯.৮ ডলার, সে জায়গায় এই বছরে আয় করেছে ৯৮.০৮ ডলার। কোম্পানি কর্তারা স্বীকার করেছেন, বিশ্ব বাজারে তেলের বাড়তি দাম তাঁদের কাছে আশীর্বাদ। পেট্রোনেট এলএনজি এক বছরে মুনাফা হিসাবে সিন্দুকে পুরেছে ৩৫৫২.৩৫ কোটি টাকা। এসার, কেয়ার্ন ইন্ডিয়া, টাটা পেট্রোডাইন, আদানি গোষ্ঠীর একাধিক তেল-গ্যাস কোম্পানি, গেইল, ভারত পেট্রোলিয়াম, হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি কোম্পানিও বিগত আর্থিক বছরে রেকর্ড লাভ করেছে (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ২৭ মে ২০২২, মানি কন্ট্রোল.কম ২৪ জুন ২০২২, এনার্জি ওয়ালর্ড.কম, ১৭ মে ২০২২ )। তা হলে দেখা যাচ্ছে, লোকসানের প্রচারটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বাস্তবে সরকারি এবং একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের হাতে থাকা তেল কোম্পানিগুলির আকাশছোঁয়া মুনাফার সামান্য একটু ছাঁটাই করার কথা বললেই তো সরকার ভারতে তেল গ্যাসের দাম অনেকটাই কমতে পারে!
সরকার তা করে না। সরকার করে উল্টোটা। রয়টার এবং ব্লুমবার্গের মতো আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থাগুলি দেখিয়েছে, লাভ কমাতে বলা দূরে থাক, ভারত সরকার বেসরকারি কোম্পানিগুলির বাড়তি লাভের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে মার্কিন শেল অয়েল কোম্পানিগুলি এবং আরব তেল উৎপাদকরা অশোধিত তেলের দাম বাড়িয়েছে বিপুল হারে। বর্তমানে দুটি ক্ষেত্রেই এক ব্যারেল তেলের দাম ১১০ ডলারের আশেপাশে থাকছে। অথচ সব সময়েই কম থাকা রাশিয়ান তেলের দাম এখন ইউরোপ আমেরিকার নানা নিষেধাজ্ঞায় একেবারে তলানিতে নেমে দাঁড়িয়েছে ব্যারেল প্রতি ৩০ ডলার। এই সুযোগে ভারতীয় বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলি গত দু’মাসে রাশিয়ান তেল আমদানি বাড়িয়েছে ৫০ গুণ। ফেব্রুয়ারির আগে ভারতে আমদানি করা তেলের মাত্র ০.২ শতাংশ ছিল রাশিয়ান, এখন তা মোট আমদানির ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এই তেল শোধনের পর ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার কিছু দেশে রপ্তানি করছে ভারতীয় বেসরকারি কোম্পানিগুলি। যুদ্ধের কারণে সরাসরি রুশ তেল থেকে বঞ্চিত ইউরোপের বাজারে এই তেল বিকোচ্ছে চড়া দামেই। রয়টারের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, রিলায়েন্স, টাটা, কেয়ার্ন ইন্ডিয়া, আদানি, এসার অয়েলের মতো ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন বেসরকারি কোম্পানিগুলি কমপক্ষে প্রতি ব্যারেলে ৫০ ডলারের বেশি মুনাফা ঘরে তুলছে।
ভারতের বাজারেও তারা এই সস্তার তেলের একটা অংশ আগুন দামে বেচছে। অথচ দেশের বাজারে সস্তায় এই তেল বেচলে এখনই তো পেট্রল-ডিজেলের দাম অর্ধেকেরও কম করা যায়। তেলমন্ত্রী বিষয়টি না জানার ভান করে বলেছেন কার শোধনাগারে কোন দেশের তেল আছে তা আমি আলাদা করে খুঁজব কী করে? যেন বিশাল বিশাল তেলের জাহাজগুলি অদৃশ্য হয়ে ভারতে আসছে, সরকার একেবারে টেরটি পাচ্ছে না! আমদানি করা তেলের হিসাব যে শোধনাগারের ট্যাঙ্কে নেমে নিতে হয় না তা তেলমন্ত্রী জানেন না এমনটা কি সত্যি? আসলে তাঁর শুধু নয়, পুরো সরকারটারই টিকি বাঁধা আছে এই একচেটিয়া মালিকদের কাছেই।
পুঁজিবাদী দেশে সরকার যে পুঁজিপতিদের ম্যানেজার হিসাবেই ভূমিকা পালন করে তা আর একবার স্পষ্ট করে দিল ভারত সরকারের এই আচরণ। তেল-গ্যাসের বিপুল লাভজনক ক্ষেত্রকে একচেটিয়া মালিকদের হাতে পুরোপুরি তুলে দেওয়ার চেষ্টা কংগ্রেস সরকারের সময় থেকেই চলছে। ওএনজিসির গ্যাস-তেল ক্ষেত্রে রিলায়েন্সের চৌর্যবৃত্তি দেখেও সরকার অতীতে নীরব থেকেছে। বঙ্গোপসাগর, আরব সাগরের একাধিক তেলখনি ইন্ডিয়ান অয়েল-আদানিদের যৌথ মালিকানার নামে বেসরকারি হাতেই তুলে দিয়েছে বিজেপি সরকার। ভারতে পেট্রোলিয়াম, টেলিকম, শক্তি, বিদেশ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকে কে মন্ত্রী বা শীর্ষ আমলার চেয়ারে বসবেন তা যে একচেটিয়া মালিকদের লবি ঠিক করে দেয় এ কথা টেলিকম কেলেঙ্কারির সময় সরাসরি সামনে এসেছে। নানা প্রতিবেদনে একাধিক সাংবাদিকও বারবার তা তুলে ধরেছেন। এ কারণেই বিজেপির তহবিলে এই কর্পোরেট কর্তারা অনুদান ঢেলে দেন। এই পয়সাতেই চলে কোটি কোটি টাকায় অন্য দলের এমএলএ-এমপি কেনা, পাঁচতারা হোটেলে অসংখ্য ঘর ভাড়া করে সরকার ফেলার চক্রান্তের ছক কষা। এই পথেই আসে ‘ফকির’ নেতা ও তাদের সঙ্গীদের প্রাইভেট প্লেনে করে ঘুরে বেড়ানোর জন্য শত শত কোটি টাকা। ক্ষমতায় বসতে ও তা ধরে রাখতে প্রশাসন, আমলা, প্রচারমাধ্যম, মাফিয়া কেনার জন্যদেদার টাকার জোগানও এতেই নিশ্চিত হয়। অতএব জনগণ দেশপ্রেমের বাণী শুনুন আর চড়া দামে তেল কিনুন। সস্তা তেল যাবে বিদেশের বাজার ধরতে। ধনকুবেরদের সিন্দুক ভরাতে এ বড় মোক্ষম দাওয়াই বিজেপি সরকারের।