এ খবর আগেই প্রকাশ্যে এসেছিল, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ভাড়াটে সেনা হিসাবে নিয়োগ করা হচ্ছে ভারতীয় যুবকদের। এবার খবর এল, সেই যুদ্ধে ভারতের ১২ জন তরুণের মৃত্যু হয়েছে এবং ১৬ জনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ খবর সামনে আসার পর কেন্দ্রীয় সরকারের বিদেশমন্ত্রক নিয়মমাফিক জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আটকে পড়া ভারতীয় তরুণদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তারা রাশিয়ার সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে (এনডিটিভি ওয়ার্ল্ড, ১৭ জানুয়ারি, ’২৫)। কিন্তু এটুকুতেই কি তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যেতে পারে? নিজের দেশ ও পরিজনদের থেকে বহু দূরে অন্য একটি দেশের বাধানো যুদ্ধে প্রাণ হারানোর মতো মর্মান্তিক ঘটনা বহু প্রশ্ন তুলে দিয়ে যায়।
এই যুবকদের কাজ দেওয়ার নামে রাশিয়ায় পাঠিয়েছিল একটি বেসরকারি নিয়োগ সংস্থা। সেখানে পৌঁছানোর পর কাজ দেওয়ার বদলে তাদের ইউক্রেনের যুদ্ধে পাঠানো হয়। প্রশ্ন হল, এই ধরনের অনৈতিক ও বেআইনি কাজে লিপ্ত নিয়োগ সংস্থা এ দেশে কাজ চালিয়ে যেতে পারছে কী করে! গত বছরের শুরুর দিকেই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল যে কাজ দেওয়ার নামে বেশ কিছু এজেন্ট ও কোম্পানি ভারতের যুবকদের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠাচ্ছে। জানা সত্ত্বেও সেইসব এজেন্ট ও কোম্পানিগুলিকে ভারত সরকার নিষিদ্ধ করেনি কেন? এতদিনেও যুদ্ধে ভাড়া খাটানোর জন্য রাশিয়ায় পাচার হয়ে যাওয়া ভারতীয় যুবকদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা কেন করেনি তারা? কেনই বা ভারতীয় তরুণদের যুদ্ধে নিয়োগ বন্ধ করতে রুশ সরকারকে বাধ্য করেনি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার? দীর্ঘ দু’বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক সেনা দরকার। রুশ সরকারের সেই প্রয়োজন মেটাতেই কি তার সঙ্গে যোগসাজশ করে এ ভাবে সেনা জোগান দিয়ে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার? তাই যদি হয়, তা হলে এই চরম দুঃখজনক মৃত্যুগুলির দায় তো তারা এড়াতে পারে না! নাকি ভয়ঙ্কর বেকার সমস্যার মুখে পড়ে সব জেনেশুনেই তারা এই চরম অনৈতিক মানুষ পাচার অবাধে চলতে দিয়েছে?
বুঝতে অসুবিধা হয় না, চরম বেকার সমস্যায় বিপর্যস্ত তরুণরা দেশের ভিতরে কাজ না পেয়ে নিতান্ত বাধ্য হয়েই এইসব এজেন্ট ও কোম্পানিগুলির কাছে নাম লিখিয়েছিল। এই তরুণদের দুর্দশার সুযোগ নিয়েই এরা রুশ কর্তৃপক্ষের কাছে এদের ভাড়াটে সেনা হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার জন্য পাঠিয়েছিল। প্রশ্ন হল, এই তরুণরা বিদেশি— এ কথা জেনেও রাশিয়া এদের যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিল কেন? নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে যে যুদ্ধ তারা ইউক্রেনের উপর চাপিয়েছে, অন্য একটি দেশের বেকার যুবক, যে দেশ ও তার নাগরিকদের সঙ্গে সেই স্বার্থের কোনও রকম সম্পর্কই নেই, তাদের সেই যুদ্ধের বলি হতে পাঠানোর কোনও নৈতিক অধিকার কি রাশিয়ার থাকতে পারে? এ তো স্পষ্টতই ভারতের সার্বভৌমত্বকে লংঘন করা!
সাম্রাজ্যবাদের এই যুগে পৌঁছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও তার ধারক-বাহক সরকারগুলির কাছে বাস্তবে সামান্যতম নীতি-নৈতিকতাও আর আশা করা যায় না। সাধারণ মানুষের প্রাণের দাম—সে মানুষ নিজের দেশের নাগরিক হোক বা অন্য দেশের— তার কাছে কানাকড়িও নয়। তাই হন্যে হয়ে কাজ খোঁজা বেকার যুবকদের অন্য দেশের় যুদ্ধে কামান-বন্দুকের মুখে ঠেলে দিতে বাধে না কেন্দে্রর বিজেপি সরকারের। আবার রাশিয়ার সরকারও দ্বিধা করে না নিজের স্বার্থে লাগানো যুদ্ধে অন্য দেশের তরুণদের প্রাণ বলি দিতে। যতদিন পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ টিকে থাকবে, ততদিন এই বর্বরতার অবসান নেই।