রাফাল কেলেঙ্কারিতে নাজেহাল প্রধানমন্ত্রী সংসদ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন৷ তাঁর পারিষদ–মন্ত্রীরা স্পষ্ট উত্তরের বদলে নাটকীয় ভঙ্গিতে কিছু আবেগপূর্ণ কথার মারপ্যাঁচে আসল বিষয় এড়িয়ে যেতে মরিয়া৷ ঠিক এই সময় কেন্দ্রীয় সরকার ক্রিশ্চিয়ান মিশেল নামে এক ব্যক্তিকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী থেকে ধরে নিয়ে এসে প্রবল দুর্নীতি বিরোধিতার ভান করছেন৷ এই ব্যক্তি বিগত কংগ্রেস সরকারের আমলে এ দেশে ভি ভি আই পি–দের জন্য হেলিকপ্ঢার বিক্রির বরাত পেতে অগুস্তা ওয়েস্টল্যান্ড কপ্টার কোম্পানির হয়ে দালালি করেছিলেন৷ আশ্চর্য সমাপতন, এই মিশেল নাকি ঠিক এই সময় কপ্টার কাণ্ডে ‘মিসেস গান্ধী’ এবং ‘ইতালীয় মহিলার ছেলে’ ‘বিগ ম্যান আর’–এর নাম নিয়েছেন শুনেছে কে? কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা এনফোরসমেন্ট ডাইরেক্টরেট বা ইডি–ফিসাররাই একমাত্র শ্রোতা৷ ফলে জমে উঠেছে তরজা৷ কে বড় দুর্নীতিগ্রস্ত, বিজেপি না কংগ্রেস? এই নিয়ে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন একেবারে সরগরম হয়ে উঠেছিল৷
সামনেই লোকসভা নির্বাচন, ঠিক তার আগে বিশেষত একেবারে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ধাক্কা খাওয়ার পর এই ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়৷ ২০১৪–র ভোটের আগে করপোরেট মিডিয়ার ফলাও প্রচার নরেন্দ্র মোদিকে ঘিরে যে ‘মিথ’–এর জন্ম দিয়েছিল পাঁচ বছরের ব্যবধানে আজ তা সম্পূর্ণ মিথ্যা হয়ে গিয়েছে৷ নোটবন্দি–জিএসটির আঘাত, ভয়াবহ বেকারি, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, কৃষক অসন্তোষ, মন্ত্রী–নেতাদের মদতে ব্যাঙ্ক–লুঠেরাদের বিদেশে পাড়ি, শিল্পপতি আম্বানি ও বিজেপি নেতাদের পকেট ভরাতে রাফালের কেলেঙ্কারির মতো নানা ঘটনা জনমানসকে এতটাই তিক্ত ও আলোড়িত করেছে যে উগ্র হিন্দুত্বের বিষ ছড়িয়েও তাকে মোকাবিলা করতে পারেনি বিজেপি৷
মিশেলকে হাতিয়ার করে বিজেপির চেষ্টা কংগ্রেসও যে দুর্নীতিগ্রস্ত তা দেখিয়ে নিজের দুর্নীতির অভিযোগকে কিছুটা হালকা করে দেওয়া৷ মিশেল–অস্ত্রে কংগ্রেস কতটা কাত হবে সেটা ভবিষ্যতই বলবে৷ কিন্তু প্রশ্ন হল, অগুস্তা–কপ্টার কাণ্ডে বিগত কংগ্রেস সরকার যে নিজেদের এবং টাটাদের পকেট ভরানোর ব্যবস্থা করেছে, সে কথা গত পাঁচ বছরে নরেন্দ্র মোদিদের মনে পড়ল না কেন? ২০১৪–তে এ দেশের একচেটিয়া পঁুজিমালিকদের আশীর্বাদ একজোট হয়ে গিয়েছিল বিজেপির ঝুলিতে৷ কংগ্রেসকে প্যাঁচে ফেলতে গিয়ে বৃহৎ করপোরেট মালিক টাটাদের চটানোর ইচ্ছা সেই সময় বিজেপির ছিল না বলেই কি? কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে৷ করপোরেটের আশীর্বাদী সাদা–কালো টাকার নৈবেদ্য ভাগ হয়ে যাচ্ছে৷ একতরফা বিজেপির প্রতি তাদের সমর্থন যে থাকছে না সাম্প্রতিক ভোটের ফল আর প্রচারমাধ্যমে চোখ রাখলেই তা বোঝা যায়৷ একই সাথে বাড়ছে বিজেপির বিরুদ্ধে জনরোষ আছড়ে পড়ার আশঙ্কাও৷ ফলে করপোরেট মালিকদের বেশ বড় অংশ প্রায় ডুবতে বসা কংগ্রেসকে আবার ভাসিয়ে তুলে জনগণের ত্রাতা হিসাবে সাজাতে তৎপর৷ তাদের আশীর্বাদে কংগ্রেসও অনিল আম্বানির মতো ধনকুবেরদের বিরুদ্ধে পর্যন্ত গরম গরম কথা বলে জনগণকে একেবারে মোহিত করে দেওয়ার চেষ্টায় রত৷ এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ বিজেপির মনে পড়ে গেছে অগুস্তা হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারির কথা৷
বিজেপি লড়বে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাহলে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় বসার তিন মাসের মধ্যে তারা ঘুষ দেওয়ায় অভিযুক্ত অগুস্তা ওয়েস্টল্যান্ড এবং তার সহযোগী ফিনমেকেনিকো–র উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল কেন? আসলে ঘটনা এটাই, দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য কংগ্রেস, বিজেপি কারওরই মাথাব্যথা নেই৷ দুর্নীতি এদের হাতে এমন একটি তাস যা তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজে ব্যবহার করতেই বেশি আগ্রহী৷ আর কিছু নয়৷
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কংগ্রেস বা বিজেপি যতই গলাবাজি করুক, এদের প্রত্যেকেরই গায়ে লেগে রয়েছে দুর্নীতির অজস্র কালো দাগ৷ এদের কেউ অভিযুক্ত বফর্স কেলেঙ্কারি, ট্রেজারি কেলেঙ্কারিতে, আবার কেউ অভিযুক্ত জমি কেলেঙ্কারি, কফিন কেলেঙ্কারিতে৷ এ রকম হাজার একটা কেলেঙ্কারির এরা নায়ক৷ প্রত্যেকটি কেলেঙ্কারি থেকে লাভবান হয় কোনও না কোনও পুঁজিপতি গোষ্ঠী৷ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে ওঠা সরকারি ভাণ্ডারের অর্থ পুঁজিপতিদের সেবায় বিলিয়ে দেওয়া বা কাটমানির খেলায় এরা কেউ কারও থেকে পিছিয়ে নেই৷ বস্তত, ভোটসর্বস্ব রাজনীতির এটাই বৈশিষ্ট্য৷ যারাই শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির প্রসাদ ও আনুকূল্যে রাজনৈতিক মঞ্চে টিকে থাকতে চায়, শাসক–শোষক শ্রেণির কাছে আত্মবিক্রয় করে নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙক্ষা পূরণ করে, পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস হয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষাই যাদের একমাত্র কাজ, তাদের রাজনীতি দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত হতে বাধ্য৷
আজকের পরিষদীয় রাজনীতি প্রধানত যে দুই দলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে, সেই কংগ্রেস ও বিজেপির আজ আর দেশের মানুষকে কিছু দেওয়ার নেই৷ এটাই জনগণের জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতা৷ অথচ ভোট এলে তার আবর্তে পড়ে সাধারণ মানুষ এসব কথা ভুলে যায়৷ তাদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়৷ ভুলিয়ে দেয় করপোরেট মিডিয়ার অবিশ্রান্ত প্রচার৷ পুঁজিপতি শ্রেণি জনগণের সামনে হাজির করে সেই দুই পক্ষকে–যারা তাদের পরিকল্পিত, তাদেরই মদতপুষ্ট দ্বি–দলীয় পরিষদীয় ব্যবস্থার দুই প্রধান শরিক৷ বলা হয়, বেছে নাও এদের কাকে চাও৷ যেন এদের বাইরে আর কেউ নেই৷ আবার এদের মধ্যে যাকে পুঁজিপতি শ্রেণি ক্ষমতায় আনতে চায়, তার দিকে প্রচারের পাল্লা ভারী থাকে৷ জনগণ না–বুঝে তাদের পাতা ফাঁদে পা দেয়৷ এ ভাবেই জনগণ ঠকে, আর ওরা জেতে৷ ভোটে জেতে দল, মানুষ জেতে লড়াইয়ের ময়দানে৷ এই সত্যকে ভুলে গেলে ঠকতেই হবে৷