রাফাল দুর্নীতি: ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’

 

ফরাসি সংবাদ সংস্থা ‘মিডিয়াপার্ট’ হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে চলা কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের। ৮ নভেম্বর সংবাদ সংস্থাটির প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীনে থাকা সিবিআই এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে থাকা ইডি ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবরেই সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছিল যে, রাফাল যুদ্ধ বিমান কেনার জন্য বিপুল পরিমাণ ঘুষের লেনদেন হয়েছিল। কিন্তু এই প্রমাণ হাতে পেয়েও দুটি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাই হাত গুটিয়ে থেকেছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি নাকি এমনই এক সৈনিক! কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আড়ালে আড়ালে শুধু নিজের খাওয়া নয়, অন্যদের খাওয়ার বন্দোবস্তও করে রেখেছে তাঁর সরকার।

বিজেপিরই দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ শৌরি এবং যশবন্ত সিনহা ২০১৮-র অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহের আশেপাশে রাফাল বিমান কেনায় দুর্নীতি সংক্রান্ত ফাইল তৎকালীন সিবিআই ডিরেক্টর অলোক বর্মার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তার কয়েকদিন বাদে মরিশাসের অ্যাটর্নি জেনারেল ভারত সরকারকে জানিয়েছিলেন, সে দেশে নথিভুক্ত ভুয়ো কোম্পানির মাধ্যমে ঘুষের আদানপ্রদান হয়েছে। কিন্তু ঠিক তার পরেই সিবিআই ডিরেক্টরকে মাঝরাতে অপসারণ করা হয়, তাঁর অফিসে তল্লাশি চালানো হয়। তারপর থেকে এই তদন্ত পুরোপুরি ধামাচাপা পড়ে যায়।

মিডিয়াপার্ট জানিয়েছে, ভারতীয় দালাল সুষেণ গুপ্ত ‘ইন্টারস্টেলার টেকনোলজিস’ নামে একটি ছদ্ম কোম্পানি খুলে তা মরিশাসে নথিভুক্ত করায়। ২০০২ সাল থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর অস্ত্র কেনাবেচার টেন্ডারগুলিতে বিদেশি কোম্পানিগুলির সাথে লেনদেনে এই কোম্পানি মধ্যস্থতার কাজ করতে থাকে। তারা কাটমানির সাহায্যে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তাদের হাত করে সেনাবাহিনীর অর্ডার ধরে দিতে ইউরোপের অস্ত্র কোম্পানিগুলিকে সাহায্য করতে থাকে।

সে সময় দেশে ছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্বে চলা বিজেপি সরকার। পরবর্তীকালে কংগ্রেস সরকারের আমলেও একই ভাবে দালালি চলতে থাকে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে তা আরও প্রকট হয়েছে।

ভারতবাসী মাত্রেই জানে বোফর্স কামানই হোক বা অন্য কোনও সামরিক অস্ত্র, বিমান, হেলিকপ্টার ইত্যাদি কেনাবেচায় দালালচক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। এই ইন্টারস্টেলার কোম্পানিও একই কাজ করত। এই ধরনের কোম্পানি কেবলমাত্র টাকা লেনদেনের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে বলে এদের বলা হয় ‘শেল কোম্পানি’। ইন্টারস্টেলার কোম্পানি কয়েক দফায় ব্যাঙ্কের ভুয়ো ইনভয়েস তৈরি করে ৭৫ লক্ষ ইউরো (৬৪ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা) ২০১২ সালে ঘুষ হিসাবে দিয়েছে। মিডিয়াপার্টের তদন্ত অনুসারে রাফাল নির্মাতা দাসো অ্যাভিয়েশন কোম্পানি এই দালালের মাধ্যমে কমপক্ষে ১১০ কোটি টাকা কাটমানি ভারতীয় কর্তাদের দিয়েছে। তার বলেই তারা রাফাল বিমান বিক্রির অর্ডার পেয়েছে। ভারতীয় কর্তাদের ঘুষ দিয়ে সুষেণ গুপ্তারা প্রতিরক্ষা দপ্তরের গোপন নথিও পেয়ে গিয়েছিল। ফলে দরকষাকষির সময় ভারতীয় কর্তারা মুখ খোলার অনেক আগেই দাসো কোম্পানি তার ছক সাজিয়ে নিতে পেরেছিল। ফলে তারা এক্ষেত্রে ভারত সরকারের থেকে বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল এবং তাদের সুবিধা দেখেই চুক্তিটি হয়েছে। মরিশাসের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছ থেকে এমন ভুয়ো ইনভয়েস ও ফাঁস হওয়া প্রতিরক্ষা নথির সুনির্দিষ্ট তথ্যই পেয়েছিল সিবিআই এবং ইডি। এই সংবাদ সংস্থার তদন্ত দেখিয়েছে একই কায়দায় ইতালির ফিনমোনিকা কোম্পানির তৈরি অগুস্তা হেলিকপ্টার কেনার জন্যও সুষেণ গুপ্তার কোম্পানির মাধ্যমে কাটমানি বা ঘুষের লেনদেন হয়েছে।

যদিও কাটমানি ও টেবিলের তলার লেনদেন এখানেই শেষ নয়। ২০১২ সাল পর্যন্ত এই কাটমানির প্রমাণ হাতে পেয়েও বিজেপির সরকারের শীর্ষ কর্তারা কেন চুপ রইলেন সেটাও মোটেই আশ্চর্যের নয়! ওই সময়কার কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির এতবড় প্রমাণ পেয়েও খোদ প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তর সিবিআই ও ইডিকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে বসিয়ে রাখল কেন? কেঁচো খুঁড়তে আরও বড় কেউটে বেরনোর সম্ভাবনা থেকেই?

আসলে রাফাল বিমান কেনার চুক্তির সবচেয়ে সন্দেহজনক পর্যায় হল ২০১৫ সালের পর থেকে। যে সময় প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি সরকারের একেবারে শীর্ষ কর্তাদের হস্তক্ষেপে দীর্ঘ সময় ধরে দরাদরির পর প্রায় চূড়ান্ত চুক্তিটি অদ্ভূতভাবে বদলে যায়। ১২৬টির জায়াগায় বিমানের সংখ্যা কমে হয় মাত্র ৩৬। অন্যদিকে প্রতিটি বিমানের দাম ৫২৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৬৭০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। আগের চুক্তিতে ছিল দাসো কোম্পানি ১৮টি বিমান দেবে সম্পূর্ণ তৈরি অবস্থায়। আর রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি হিন্দুস্তান এরোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল) দাসোর অফসেট পার্টনার হিসাবে ভারতেই ১০৮টি এই বিমান তৈরি করবে। বিমান রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এবং প্রযুক্তিও পাবে হ্যাল। কিন্তু ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে রিলায়েন্স কর্তা অনিল আম্বানিকে সাথে নিয়ে ফ্রান্সে গিয়ে সেখানকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওলান্দের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন। সেই সময় অফসেট পার্টনারের স্থানে হ্যালকে আকস্মিকভাবে সরিয়ে দিয়ে আম্বানি সাহেবের সদ্যোজাত কোম্পানি ‘রিলায়েন্স ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ’ চলে আসে। ২০১৮ সালে প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট একাধিকবার বলেন, হ্যালের বদলে আম্বানির কোম্পানিকে বেছে নেওয়ার জন্য ফরাসি সরকার বা দাসো কোম্পানি দায়ী নয়। ভারত সরকারের (পড়ুন প্রধানমন্ত্রী) অনুরোধেই এই পরিবর্তন। শুধু তাই নয় ভারত সরকারের অবস্থানের জন্যই রাফাল চুক্তিতে যে দুর্নীতি বিরোধী ধারা ছিল তা মুছে দিতে পেরেছিল দাসো কোম্পানি এবং তার নিযুক্ত দালালরা। ভারতীয় ‘দেশপ্রেমিক’ সেনা কর্তা, আমলা, মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে রক্ষাকবচটাই তুলে দিয়ে এসেছেন।

পুঁজিবাদী বাজারের তীব্র সংকট থেকে বাঁচতে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি ক্রমাগত অর্থনীতির সামরিকীকরণের পথে গেছে। বর্তমান সর্বাত্মক বাজার সংকটকে মোকাবিলা করার জন্য তাদের হাতে একমাত্র হাতিয়ার যুদ্ধাস্ত্রের কারবার। একই সাথে যুদ্ধাস্ত্রের কারবার যত বাড়ছে তত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তা নিয়ে দুর্নীতির কারবার। দেশের নেতা-মন্ত্রীরা জনগণকে বোঝান দেশ রক্ষার জন্য সামরিক বাহিনীকে আরও অস্ত্র দিতে হবে, তাই দেশের সমস্ত সম্পদ ঢেলে হলেও আরও মারণাস্ত্র কিনতে হবে। এই ব্যবসার মধ্য দিয়ে পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার পাহাড় আরও উঁচু হয়। আর নেতামন্ত্রী-আমলা-সেনাকর্তারা কমিশন খেয়ে পকেট ভারি করেন। খাঁচার তোতা সিবিআই সে কারণেই টুঁ শব্দটি করতে সাহস করেনি একথা নিশ্চিত। কংগ্রেস বিজেপির মধ্যে তরজা চলছে, কে কত বেশি কাটমানি খেয়েছে তা নিয়ে। এদিকে রাফাল দুর্নীতির অভিমুখ পৌঁছে গেছে প্রধানমন্ত্রীর দোরগোড়ায়। এই দুর্নীতির তদন্ত ও অভিযুক্ত দোষী নেতা-মন্ত্রী-সেনাকর্তাদের শাস্তিতে সরকারকে বাধ্য করতে হলে প্রবল জনমত গড়ে তোলা দরকার। পুঁজিবাদী দলগুলি সকলেই কোনও না কোনও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাদের সক্রিয়তা আজ দুরাশা। ফলে নাগরিক সমাজকেই এ ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ১৫ সংখ্যা ১৯ নভেম্বর ২০২১