ফ্রান্সের দাসো এবং তার অংশীদার থালেস-এর কাছ থেকে রাফাল বিমান চুক্তির জন্য ঘুষ নিয়ে তাদের পক্ষে দরাদরিতে সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি করে দিয়েছিল এক ভারতীয় ব্যবসায়ী। শুধু তাই নয় অগুস্তা হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্তের সময় ভারতের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট অর্থাৎ ইডি একথা জেনেও কোনও তদন্ত চালায়নি। সম্প্রতি এই সত্যই সামনে এনেছে ‘মিডিয়াপার্ট’নামে প্যারিসের একটি অনলাইন সংবাদ সংস্থা।
সম্প্রতি তিন কিস্তিতে প্রকাশিত তাদের অনলাইন রিপোর্ট প্রকাশ করে সংস্থাটি জানিয়েছে, সুষেণ গুপ্তা নামে ভারতের এক ব্যবসায়ীকে দুই ফরাসি কোম্পানি কয়েক লক্ষ ইউরো দিয়েছে। ভারতের সাথে ফরাসি কোম্পানির চুক্তির সময় যাতে ফরাসিরাই সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করার জন্যই এই অর্থ দাসো কেম্পানি খরচ করেছে। রিপোর্টটি বলছে,এই তথ্য ইডি জানতে পেরেছিল অগুস্তা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্তের সময়েই। কিন্তু সেই সময় কেস ফাইলেইডি বলেছিল,এই তথ্য নিয়ে আলাদা তদন্ত হবে। কিন্তু ২০১৯ থেকে আজ পর্যন্ত এ নিয়ে তদন্ত দূরে থাক,বিষয়টিকে যেন ভুলেই বসে আছে ইডি! কার নির্দেশে? এ সত্য আজ জানতে চায় ভারতের জনগণ।
মিডিয়াপার্ট দেখিয়েছে,সুষেণ গুপ্তা প্রতিরক্ষা দপ্তরের গোপন নথি হাতিয়েছে এবং তা ব্যবহার করে দরকষাকষির সময় বিমানের দাম বাড়িয়ে নিতে পেরেছে দাসো এবং থালেস। সংবাদসংস্থাটির নথি বলছে,ভারতীয় তদন্তকারী হিসাবে ইডি এই তথ্যও পেয়েছিল। কিন্তু তারা কোনও পদক্ষেপ করেনি। দাসো কোম্পানি গুপ্তাকে ভাড়া করেছিল ২০০০ সাল নাগাদ,যখন কেন্দে্র ছিল কংগ্রেসের মনমোহন সিং সরকার। সেই সময় ভারত সরকার ১২৬টি যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করতে চেয়েছিল। এই সময় থেকে শুরু করে ১৫ বছর ধরে দুটি ফরাসি সংস্থা গুপ্তাকে ঘুরপথে বেশ কয়ে লক্ষ ইউরো দিয়েছে যাতে ভারতে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার চুক্তিতে প্রভাব খাটানো যায়। যদিও কোনও লেনদেনই সরাসরি গুপ্তার রেজিস্টার্ড কোম্পানির সাথে দাসো বা থালেসের হয়নি। অগুস্তা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারির সময় যেমন হয়েছিল,সেই কায়দাতেই বিদেশে নথিভুক্ত নানা কোম্পানি এবং আইডিএস নামক একটি সফটওয়্যার কোম্পানির সাহায্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঘুরপথে লেনদেন হয়েছে বলে মিডিয়াপার্ট জানিয়েছে। এই রিপোর্ট দেখাচ্ছে,ইডি হেলিকপ্টার কেনা সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির তদন্তে কেস ফাইলে লিখেছিল,ভারতীয় অফিসারদের ঘুষ দেওয়ার জন্য গুপ্তা এই অর্থ পেয়েছে কি না এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা চুক্তিতে কী ভাবে ঘুষের কারবার চলেছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।
ভারতের জন্য যুদ্ধবিমান তৈরির বরাত পাওয়ার পর তাদের ভারতীয় অংশীদার বাছতেও গুপ্তাকে কাজে লাগায় দাসো কেম্পানি এবং তার সহযোগীরা। নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় বসার পর ২০১৬ সালে ১২৬ টির বদলে ৩৬টি বিমান কেনার চুক্তি হয়। ফরাসি সরকার এবং ভারত সরকার যৌথভাবে এই চুক্তির মধ্যস্থতা করে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান নির্মাণকারী অভিজ্ঞ সংস্থা হিন্দুস্থান এরোনটি’ লিমিটেডের (হ্যাল)-এর সাথে প্রায় সম্পূর্ণ চুক্তি আকস্মিকভাবে বাতিল হয়ে যায়। হঠাৎ করে ভারতীয় ধনকুবের অনিল আম্বানির মালিকানায় সদ্য জন্ম নেওয়া কোম্পানি দাসো কোম্পানির সাথে এই অত্যাধুনিক বিমানের ভারতীয় অংশীদার রূপে আবির্ভূত হয়। আগেকার চুক্তি থেকে ৯০টি বিমান কম দিয়েও ফরাসি সংস্থাটি প্রতিটি বিমানের বিপুল পরিমাণ দাম বাড়িয়ে নিতে সমর্থ হয়। ফলে ভারত সরকারকে অনেক বেশি অর্থ গুনে দিতে হয়েছে। মিডিয়াপার্ট তার রিপোর্টে বলেছে গুপ্তার মাধ্যমে ভারতীয় দরকষাকষির টিমের কম্পিউটার নথি পর্যন্ত দাসোর হাতে আগেই এসে গিয়েছিল। ফলে ভারতীয় প্রতিনিধিরা মুখ খোলার অনেক আগে দাসো তার ছক সাজিয়ে নিতে পেরেছিল।
যদিও এই রিপোর্টই প্রথম নয়,ফরাসি পোর্টাল ‘ইন্টেলিজেন্স অনলাইন’২০১৬ সালের মে মাসে একটি ইংরেজি প্রবন্ধে এই গুপ্তা ও তার পুত্রদের সাথে বিজেপির শীর্ষস্থানীয় কর্তা এবং ভারতীয় বিমান বাহিনীর কিছু কর্তার দহরম-মহরমের কথা তুলে ধরে। শেষ পর্যন্ত রাফাল চুক্তিটি সেপ্টেম্বর ২০১৬ তে স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীকালে প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওলান্দের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে,ওলান্দে ২০১৮ সালে একাধিকবার বলেছেন,চুক্তির অংশীদার হিসাবে রিলায়েন্সকে বেছে নেওয়ার পিছনে ফরাসি সরকারের কোনও ভূমিকা ছিল না। ভারত সরকারের ইচ্ছাতেই তা হয়েছে।
মিডিয়াপার্ট আরও দেখিয়েছে,চুক্তিতে প্রথমে যে ‘অ্যান্টিকরাপশন ক্লজ’ অর্থাৎ ঘুষ এবং দুর্নীতি বিরোধী শর্ত রাখা হয়েছিল,গুপ্তার সাহায্যে দাসো তা চুক্তি থেকে বাদ দিতে সমর্থ হয়। ফলে ঘুষের কারবার হলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখন আর দাসোকে ধরতে পারবে না। এই দুর্নীতি বিরোধী শর্ত বাদ দেওয়ার জন্য কোন কোন ভারতীয় কর্তাকে প্রভাবিত করা হয়েছিল,দুর্নীতির বিরুদ্ধে গরম গরম ভাষণ দানকারী বিজেপি সরকারের নেতারা জানেন! কিন্তু বলছেন না কেন? পশ্চিমবঙ্গে ভোট ময়দানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাজার গরম করতে তাঁরা যখন আসছেন,তাঁদের ধরে এ কথা জিজ্ঞাসা করাই তো আজ ভোটারদের কর্তব্য। ভোট এলেই বিরোধী নেতাদের মামলা নিয়ে উঠেপড়ে লাগে ইডি-সিবিআই তা এখন সকলে জানে। কিন্তু এতবড় অভিযোগ পেয়েও দুবছর ধরে ইডি ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছে কার নির্দেশে? এই জবাবটা তো নরেন্দ্র মোদি সাহেব তথা বিজেপিকে দিতেই হবে।