এ বছরের রাজ্য বাজেট সম্পর্কে এসইউসিআই(সি) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য ১১ মার্চ এক বিবৃতিতে বলেন, আগামী ২০২২-‘২৩ আর্থিক বর্ষের যে বাজেট রাজ্য সরকার বিধানসভায় গত ১১ মার্চ পেশ করেছে তাকে মুখ্যমন্ত্রী যতই সাধারণ মানুষের বাজেট হিসাবে দাবি করুন না কেন, এই বাজেটের মাধ্যমে আসলে বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ করে ভোট কেনার ব্যবস্থাই করা হয়েছে। অতিমারিতে আর্থিক দুরবস্থার কারণ দেখিয়ে সরকার পরিবারপিছু যৎসামান্য টাকা দিতে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-এর মতো প্রকল্পগুলিতে ৩৩,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। তার মধ্যে কেবল লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের জন্য বরাদ্দ প্রায় ১০,৭৬৭ কোটি টাকা। মাসিক যৎসামান্য আর্থিক দানে মানুষের কোনও সমস্যার সমাধান হয় না– কেবল ভোট-বাজারে শাসক দলের স্বার্থ রক্ষা হয়। এর পরিবর্তে বেকার যুবকদের নতুন চাকরির কোনও ব্যবস্থা সরকার করলে কাজের কাজ হত, কিন্তু তার কোনও ঘোষণা বাজেটে নেই। যদিও ১ কোটি ২০ লক্ষ কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে যা অর্থহীন বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছু নয়। এই সরকারের গত ১১ বছরের কাজের দিকে তাকালেই যে কেউ তা বুঝবেন। এমনকী সরকারি দপ্তরে বহু শূন্য পদে নিয়োগও বন্ধ হয়ে আছে।
দেখা যাচ্ছে, সরকার বাজার থেকে প্রায় ৭৩,২৮৬ কোটি টাকা ঋণ করবে। অথচ ঘাটতি দেখানো হয়েছে মাত্র ২ কোটি টাকার। এ কি নিছক বুজরুকি নয়? রাজ্য সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে ৫,৮৬,৪৩৮ কোটি টাকা, যার বড় অংশই এই সরকারের দান। অর্থাৎ ১০ কোটি জনসংখ্যার এই রাজ্যে যে শিশুটি জন্মাচ্ছে তার মাথায়ও অর্ধ লক্ষের বেশি টাকা ঋণের বোঝা থাকছে। আগামী বছর সুদে আসলে ৬৯,৫১১ কোটি টাকা ঋণ শোধ করার জন্য রাজকোষ থেকে দিতে হবে। বাজেট বত্তৃতায় অর্থ দপ্তরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীর দাবি, ৩.৭৬ গুণ রাজস্ব বৃদ্ধি হয়েছে। অথচ সরকারেরই সংশোধিত হিসাব দেখাচ্ছে, গত আর্থিক বছরে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৩৩,০০০ কোটি টাকা। আর্থিক পরিসংখ্যানের এই ছলনা দিয়ে তাঁরা মানুষকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
যে কথা তাঁরা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, বাজেট বত্তৃতায় উল্লেখও করলেন না, তা হল রাজস্ব বৃদ্ধি যা হয়েছে তার সিংহভাগ এসেছে আবগারি দপ্তর থেকে অর্থাৎ মদ বিক্রি বহুগুণ বাড়িয়ে। আর এখন তো ‘দুয়ারে মদ’ প্রকল্প তাঁরা করতে চলেছেন–তাতে সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষতি যাই হোক না কেন, মহিলাদের জীবন যত দুর্বিষহ হোক না কেন, সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি হলেই তাঁরা খুশি!
সব থেকে বিস্মিত করেছে স্বাস্থ্য বাজেট। আপনারা জানেন, ‘স্বাস্থ্যসাথী’ হল এক্ষেত্রে সরকারের বহু ঘোষিত বাগাড়ম্বরপূর্ণ প্রকল্প। দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে গরিব মানুষ সরকারি হাসপাতালে বিনা পয়সায় চিকিৎসার অধিকার অর্জন করেছিল। এই ‘স্বাস্থ্যসাথী’-র মাধ্যমে গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থাই বিমা সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এটা যেমন একটা দিক, অন্যদিকে এক্ষেত্রে বরাদ্দ কি বৃদ্ধি পেল? ২০২১ সালের জুলাইয়ে যে প্রকল্প চালু হয়েছিল এবং ২০২১-‘২২ আর্থিক বর্ষে ন’মাসের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ১৯৭০ কোটি টাকা এবং আগামী বছরে তার পরিমাণ ২৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাসিক গড়ে গত বছর ছিল ২১৮ কোটি টাকা, তা কমে আগামী বছর দাঁড়াবে ২০৮ কোটি টাকা। অথচ ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পে ‘দুয়ারে সরকার’-এর মাধ্যমে কয়েক কোটি মানুষ যোগ দিয়েছেন। আবার, এই প্রকল্পের আওতায় থাকা হাসপাতালে বিল বকেয়া থাকছে, তাই নানা অছিলায় হাসপাতাল রোগী ভর্তি করতে চাইছে না। গরিব পরিবারগুলিকে মুমূর্ষু রোগী নিয়ে নাজেহাল হতে হচ্ছে–এ খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায় রোজই আসছে। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালে ২৮৩টি ওষুধ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এই স্বাস্থ্য বাজেট রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে কোন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে তা পরিষ্কার।
আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল কর্মী, পৌরস্বাস্থ্য কর্মী প্রভৃতি স্কিম ওয়ার্কার ও মোটরভ্যান, নির্মাণকর্মী প্রভৃতি অসংগঠিত শ্রমিকরা যাঁরা দফায় দফায় হাজারে হাজারে দাবি সনদ নিয়ে কলকাতার রাস্তা ভরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের জন্য কোনও পরিকল্পনা এই বাজেটে লক্ষিত হয়নি। সুন্দরবনের যে লক্ষ লক্ষ মানুষ ত্রাণ চাই না, চাই স্থায়ী বাঁধ–এই দাবিতে ভাঙা বাঁধের উপর বারবার ধরনা দিলেন, তাঁদের কথাও অর্থমন্ত্রী উচ্চারণ করলেন না। ডেউচা-পাঁচামিতে খনি তৈরি করতে গিয়ে আদিবাসীদের কোনও ভাবেই যে উচ্ছেদ করা হবে না–এমন প্রতিশ্রুতির ব্যাপারেও বাজেট নিশ্চুপ রইল। বন্ধ চা-বাগান খোলার ব্যাপারেও বাজেট মৌন। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমেত সরকারি কর্মচারীদের পেনশন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কেন, তার উত্তরও বাজেটে পাওয়া গেল না। পিপিপি মডেলে স্কুল চালানো যে তাদের অ্যাজেন্ডা নয় তার উল্লেখও বাজেট করেনি। তাই সার্বিকভাবে এই বাজেট জনস্বার্থ বিরোধী।