এস ইউ সি আই (সি)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রবীণ সদস্য ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বিশিষ্ট নেতা কমরেড গোপাল বসু ১৭ ফেব্রুয়ারি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। প্রাচীন শহর জয়নগর বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের কর্মভূমি। সমাজ সংস্কার, শিল্প-সাহিত্য চর্চা, শিক্ষার প্রসার, স্বাধীনতা আন্দোলনে আপসহীন বিপ্লবী ধারার প্রতিভূদের নামে গৌরবান্বিত এই শহর। শিবনাথ শাস্ত্রী, উমেশ চন্দ্র দত্ত, বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্যের স্মৃতিধন্য এ শহরে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট দল এস ইউ সি আই (সি)-র পলিটবুরো সদস্য কমরেড শচীন ব্যানার্জীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘শান্তি সংঘ’। কমরেড গোপাল বসু তাঁর দ্বারা আকৃষ্ট ও উজ্জীবিত হয়ে ফুটবল, ভলিবল ইত্যাদি খেলার মাধ্যমে শান্তি সংঘে জড়িত হন। ক্লাবের হাতে-লেখা প্রাচীর পত্রিকা ছিল ‘শান্তি’। দলেরই পলিটবুরো সদস্য প্রখ্যাত জননেতা কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীও তাতে লিখতেন। সেই পত্রিকা ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কালক্রমে কমরেড গোপাল বসু তাতে যুক্ত হন। ক্লাবের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ছিল ‘পরিতোষ পাবলিক লাইব্রেরি’। রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্য-শিল্পকলা সম্পর্কিত অসংখ্য বইয়ের ভাণ্ডার ছিল। ছিল অসংখ্য গ্রাহক ও পাঠক। শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ জনসংযোগের মাধ্যমে উচ্চ রুচি-সংস্কৃতি বোধসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টির তাগিদে নতুন নতুন মানুষকে এই কর্মকাণ্ডে সামিল করতে ও পরবর্তীকালে তাদের অনেককেই দলের কর্মীতে পরিণত করতে সক্ষম হতেন। এই প্রক্রিয়ারই ফসল কমরেড গোপাল বসু। তিনি যোগ্য সাহচর্য পেয়েছিলেন কমরেড সুধীর ব্যানার্জী, প্রফুল্ল সরকারদের কাছে। দলের প্রয়াত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড ইয়াকুব পৈলান, তাঁরই বন্ধু স্থানীয় দলের পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার ও তৎকালীন জেলা নেতা তাঁরই ভাই কমরেড মধু বসুর সংস্পর্শে ও নেতৃত্বে তিনি নিজেকে দলের কর্মী থেকে নেতায় উন্নীত করেন। এই শহরে দলের কর্মীদের বসে আলোচনা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভের ক্ষেত্রটি ছিল কঠিন। ‘বসুধাম’ নামে খ্যাত বাড়িটি ছিল তাঁদের আশ্রয়স্থল। এখানে মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ, শ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড নীহার মুখার্জী, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ সহ তদানীন্তন কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ নানা সভা-ক্লাস পরিচালনা করতে আসায় তা দলের কাছে ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করে। এক্ষেত্রে ঐ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কমরেড গোপাল বসুর প্রচেষ্টা ভুলে যাবার নয়।
তিনি প্রভিডেন্ট ফান্ড দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মচারী হলেও আমলাসুলভ মনোবৃত্তি ও অবৈধ অর্থ উপার্জনের মতো নিকৃষ্ট কাজ করেননি। তাঁর ভূমিকা ছিল অনুকরণীয় সততার ও এ কাজে তাঁর সংস্পর্শে আসা মানুষদের সহৃদয় সাহায্যকারী। উচ্চ পদাধিকারীদের অন্যায়-অসঙ্গত আচরণের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ করলেও তাঁদের ও মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে সকল সহকর্মীর কাছে ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। বর্তমান দলের সাধারণ সম্পাদক দলের কাজে অধিক সময় দেওয়ার জন্য যখন তাঁকে চাকরি ছাড়তে বলেন, একবার শুনেই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। চাকরি ছাড়বেন শুনে, অফিসের সহকর্মীরা দুঃখ পান, তাঁকে নিরস্ত করার জন্য দলের কাছেও লিখিত আবেদন পাঠান। সারা জীবনই তিনি ছিলেন অকপট। যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় উচ্চ কন্ঠে বলতেন। কিন্তু কোনও বিদ্বেষ থেকে তা বলতেন না বলে তিনি ছিলেন সকলের কাছে বন্ধু ও আপনজন। চাকরির সুবাদে তিনি অনুভব করেছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতার পদে থাকলেও ফটিক ঘোষের কর্মকাণ্ড দলের সংস্কৃতির পরিপন্থী। এ কথা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে বলেওছিলেন তিনি।
চাকরি করলেও বাস্তবে দলের হোলটাইমারের মতো কাজ করতেন। চাকরি স্থলে যাওয়ার জন্য সকাল ৮টা নাগাদ ট্রেন ধরতেন। তার আগে ভোরে উঠে বিভিন্ন এলাকায় কর্মী, বিভিন্ন ক্লাব-লাইব্রেরির সাথে যুক্ত ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ করতেন। ট্রেনের মধ্যে দলের অন্যান্য সহকর্মীসহ নিত্যযাত্রীদের মধ্যে উদ্দেশ্যপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা, গল্পগুজব, গ্রুপ রিডিং করতেন। সহমর্মিতার বাঁধন গড়ে তুলতেন। এর ফলে অনেকেই দলের দরদিতে পরিণত হয়েছেন। এমনকি অফিসের মধ্যেও গণদাবী সহ নানান পত্র-পত্রিকা বিক্রি, তহবিল সংগ্রহ, কর্মসূচির প্রচার চালাতেন। অফিস শেষে প্রায় প্রতিদিন দলের কেন্দ্রীয় অফিস ৪৮ লেনিন সরণিতে যেতেন। মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ সেখানে সাধারণ কর্মীদের মাঝে বসে অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক শিক্ষণীয় আলোচনা করতেন। দুর্নিবার টানে সেখানে যেতেন। সেখানে প্রায়ই সাপ্তাহিক পাঠচক্রে যোগ দিতেন। ট্রেনে ফেরার পথে অনুরূপ ভূমিকা থাকত। বিভিন্ন স্টেশনে নেমে কর্মীদের সঙ্গ দিয়ে গভীর রাতে ফিরতেন। ট্রেনের সঙ্গীদের মধ্যে তাঁর অগ্রজ সুধীর ব্যানার্জী, প্রফুল্ল সরকার প্রমুখ থাকতেন। তাঁর স্ত্রী কমরেড প্রীতি কর। হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্তা শিক্ষিকা, অনাড়ম্বর সরলমনা এই কমরেড বৃদ্ধ বয়সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অর্থ ও স্বাক্ষর সংগ্রহ করা, গণদাবীসহ পত্রপত্রিকা বিক্রি করা, বাড়ি বাড়ি ঘুরে দলের কাজ চালানোর মাধ্যমে নেতৃত্বের প্রত্যাশাকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার আজীবন চেষ্টা চালিয়েছেন ও চালাচ্ছেন। কমরেড গোপাল বসুর সাহচর্যে যৌথ পরিবারে দায়িত্বশীল পরিচালক হিসাবে প্রীতি কর ভূমিকা নিয়ে থাকেন।
কমরেড গোপাল বসুকে প্রথম সাক্ষাতে অনেকেই মনে করতেন কঠিন রাশভারী মানুষ। কিন্তু মেলামেশার মাধ্যমে সকলেই অনুভব করতেন তাঁর সারল্য, দিলখোলা, কোমল হৃদয়। মামলার বিষয়ে হোক, চিকিৎসার ক্ষেত্রে হোক, পারিবারিক সমস্যায় হোক– যে কোনও বিষয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মানুষকে সাহায্য করা তাঁর স্বভাবেই পরিণত হয়েছিল।
কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের সকল জনবিরোধী নীতি ও ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা থাকত আবেগময় তৎপরতার। শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে শোষিত শ্রেণির স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করতেন। অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ যেমন মদ-জুয়া-সাট্টা, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাঁর ঘৃণা ঝরে পড়ত। জয়নগর মজিলপুর পৌরসভার কাউন্সিলর হিসাবে এলাকার পরিবেশের স্বার্থে ও দুর্নীতি-পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতেন। সাহস ছিল তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জয়নগর ইনস্টিটিউশনে একদা এক প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে শিক্ষক-ছাত্রদের আন্দোলনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। চাল ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ‘কর্ডনিং’-এর নামে গরীব মানুষের উপর পুলিশি হয়রানি ও নিগ্রহের বিরুদ্ধে আন্দোলনে, স্টেশন মোড়ে মদ ব্যবসার বিরুদ্ধে, সমাজবিরোধী দমন– ইত্যাদি ঘটনাগুলিতে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। যখন সিপিএম বহু বছর ধরে দক্ষিণ ২৪ পরগণায় এস ইউ সি-র সংগঠন ভাঙতে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে, অসংখ্যজনকে হত্যা করেছে, মামলার পর মামলায় নেতা-কর্মীদের জীবন জেরবার করে তুলেছে, সে সময়কার আতঙ্কের পরিবেশে তিনি অকুতোভয়ে গ্রামের পর গ্রামে ছুটে গিয়েছেন মেরুদণ্ড খাড়া রেখে।
খেলোয়াড় জীবনে তাঁরই এক সঙ্গী মুসলিম পরিবারের সন্তানকে নিজেদের বাড়িতে রাখা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সে সময়ে তাঁদের বর্ধিষ্ণু হিন্দু পরিবারে এ কাজ ছিল কঠিন। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর এ জেলায় বিজেপির ষড়যন্ত্রীরা মাসের পর মাস ধরে মন্দির-মসজিদকে কেন্দ্র করে প্ররোচনার দ্বারা দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। দলের যে সব নেতা-কর্মী জনগণকে সাথে নিয়ে জান কবুল করে সে আগুন নিয়ন্ত্রণে সফল চেষ্টা চালিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রয়াত নেতা ছিলেন অন্যতম।
বিদ্যুৎ গ্রাহকদের আন্দোলনে গোটা জেলায় তিনি ঘুরেছেন। এমনকী কাকদ্বীপ-সাগর-নামখানার দুর্গম দ্বীপগুলিতে সাংগঠনিক কাজে, জনসংযোগের জন্য গরিব মানুষদের পর্ণকুটিরে মাইলের পর মাইল হেঁটে ছুটে বেড়িয়েছেন।
দলের চাঁদা নিয়মিত দেওয়া, তহবিল সংগ্রহে নিজস্ব উদ্যোগ, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্র-পত্রিকা পাঠ ও অন্যদের তাতে উৎসাহিত করা নিষ্ঠার সাথে চালিয়ে গিয়েছেন। অকপট কথা বলার কারণে কেউ দুঃখ পেয়েছেন বুঝলে তাদের কাছে ক্ষমা চাইতেও দ্বিধা করতেন না। এসবের মাধ্যমে তিনি দলের কর্মী- সমর্থক-জনগণের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে আছেন।
তাঁর মরদেহ ১৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার হার্ট ক্লিনিক থেকে রাজ্য অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে ও উপস্থিত কেন্দ্রীয়, রাজ্য ও জেলা নেতারা মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান। এরপর মরদেহ জয়নগরে জেলা অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও নেতা-কর্মীরা শ্রদ্ধা জানান। ২৭ ফেব্রুয়ারি জয়নগরে প্রকাশ্য স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। কমরেড দেবপ্রসাদ সরকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দলের পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসু ও রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য তাঁর চরিত্রের গুণাবলি তুলে ধরেন।
কমরেড গোপাল বসু লাল সেলাম