স্বাধীনতা দিবসের চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠান আর তাতে দেশের উন্নয়ন নিয়ে শাসক নেতা–মন্ত্রীদের নাটুকে বক্তৃতার গালে থাপ্পড় কষিয়ে দিয়ে গেল পুরুলিয়ার বিমলা পাণ্ডের মৃত্যু৷ একটানে ছিঁড়ে গেল জঙ্গলমহলে উন্নয়নের হাসিমুখ মুখোশটিও৷
বেশ কয়েকদিন অনাহারে থেকে মারা গেলেন ৬৭ বছরের বিমলা পাণ্ডে৷ থাকতেন ঝালদা–২ ব্লকের বামনিয়া–বেলাডি পঞ্চায়েতের লাগাম গ্রামে৷ তিনি এবং তাঁর একমাত্র সন্তান অভিরের দিন চলত ভিক্ষা করে৷ গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দাই দিনমজুর৷ তাই নিয়মিত ভিক্ষাও মিলত না৷ বহু দিন অনাহারেই কাটত তাঁদের৷ ছেলে অভির কখনও কখনও অন্য গাঁয়ে চায়ের দোকানে গ্লাস ধোয়ার কাজ করতেন৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত এভাবে আর টানতে পারলেন না বিমলা দেবী৷ অভির জানিয়েছেন, ‘‘পাঁচ–ছ’দিন মা শয্যাশায়ী ছিল৷ এই ক’দিন শুধু জল খেয়ে কাটিয়েছি৷ না খেতে পেয়েই মা মারা গেল৷’’
রাজ্যের তৃণমূল সরকারের নেতা–মন্ত্রীরা তো সব সময়ই বলেন, তাঁরা রাজ্যের এত উন্নয়ন ঘটিয়েছেন যে উন্নয়ন নাকি সর্বত্র রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে৷ তা হলে সেই উন্নয়নের দেখা কেন পেল না এই পরিবারটি? কেন পরিবারের কারও রেশন কার্ড নেই? কেন বিমলাদেবী পাননি বিধবা কিংবা বার্ধক্য ভাতা? বাংলা আবাস যোজনায় অতি দরিদ্র হিসাবে তাঁদের তো একটা বাড়ি পাওয়ার কথা, কেন তাঁরা তা পাননি? অভির জানিয়েছেন, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কার্ডও নেই তাঁর৷ মুখ্যমন্ত্রী সহ রাজ্যের মন্ত্রী–আমলা এবং শাসক দলের নিচের তলার নেতারা পর্যন্ত পথের মোড়ের বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রীর স্টাইল অনুকরণ করে ঢাক পেটান, তাঁদের রাজত্বে জঙ্গলমহল হাসছে৷ তা হলে সেই হাসি কেন দেখা গেল না বিমলাদেবী কিংবা তাঁর ছেলের মুখে? তবে কি হাসি যা আছে তা শুধু শাসক দলের নেতা–মন্ত্রীদের মুখেই– যা আসলে সাজানো? বিমলা অভিরদের কাছে যা ভয়ঙ্কর অট্টহাসির মতো শোনায়৷ এমন কত বিমলা, অভিরের অনাহারক্লিষ্ট জীবন এই নিষ্ঠুরতার তলায় চাপা পড়ে আছে তা বোধহয় এমন করে অনাহারে মৃত্যুর পরেই জানা যাবে!
এই মৃত্যুর পর যথারীতি চাপান–উতোর শুরু হয়ে গেছে– দায় কার? জেলা প্রশাসনের দাবি, পেটের রোগে বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে৷ উত্তরটা প্রশাসনের মতোই৷ নির্বিকার৷ এ রাজ্যে কংগ্রেস শাসনে অনাহারে মৃত্যুর অভিযোগ উঠলে মন্ত্রীরা তা অস্বীকার করে বলতেন, পোস্টমর্টেমে মৃতের পেটে গাছের পাতা পাওয়া গেছে৷ সিপিএম শাসনে চা–বাগানের শ্রমিক পরিবারে অনাহারে মৃত্যুর কথা মাঝে মাঝেই প্রকাশ্যে আসত৷ আমলাশোলে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা তাদের উন্নয়নের বেলুন চুপসে দিয়েছিল৷ ক’দিন আগে দিল্লিতে তিনটি শিশুর অনাহারে মৃত্যুর খবর দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল৷
সরকারি প্রকল্পের সুযোগ–সুবিধা থেকে পরিবারটি কেন বঞ্চিত রয়ে গেল, সে প্রশ্ণ তুলেছেন বাংলা দখলের লালসায় মত্ত বিজেপি নেতারা৷ এ প্রশ্ন তোলার কোনও নৈতিক অধিকার তাঁদের আছে কি? তাহলে তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে সন্তোষী কুমারীর মৃত্যুর৷ কয়েক মাস আগে এগারো বছর বয়সী এই মেয়েটিকে অনাহারে মরতে হয়েছিল যে রাজ্যে সেই ঝাড়খণ্ডে কিন্তু সরকারে রয়েছে খোদ বিজেপি৷ সাম্প্রতিক সময়ে অনাহারে মৃত্যু ঘটেছে বিজেপি শাসিত ছত্তীসগঢ় ও মধ্যপ্রদেশেও৷ বিজেপি মন্ত্রী–নেতারা তো ‘আচ্ছে দিন’ নিয়ে গলা ফাটান, কিন্তু দেশের কত ভাগ মানুষের জীবনে তাঁরা আচ্ছে দিন নিয়ে এসেছেন?
প্রধানমন্ত্রী দু’বেলা শোনাচ্ছেন, আর্থিক বৃদ্ধি কেমন তর তর করে বাড়ছে৷ সেই বৃদ্ধি তা হলে কাদের জীবনে ঘটছে? বিশ্ব ব্যাঙ্কের ২০১৬–র তথ্য, দেশের ২৭ কোটি মানুষ এখনও দারিদ্রসীমার নীচে৷ বাকিদের জীবনও মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই, বেকারি, শিক্ষা–চিকিৎসার লাগামছাড়া খরচ বৃদ্ধিতে নাজেহাল৷ তা হলে বৃদ্ধি কি কারও হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে৷ তেল–গ্যাস–টেলিকম ক্ষেত্রের ধনকুবের মুকেশ আম্বানির সম্পদের পরিমাণ এক বছরে ৬৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলার (২.৫ লক্ষ কোটি টাকা)৷ ২০১৬ সালের ২৬,০০০ কোটি টাকার সম্পত্তি এক বছরে পাঁচ গুণ বাড়িয়ে আজিম প্রেমজির সম্পত্তি হয়েছে ১, ২৪, ৫০০ কোটি টাকার৷ বাকি ধনকুবেরদের প্রথম ১০০ জনের সম্পদ বেড়েছে ২৬ শতাংশ হারে৷ কী অসম্ভব পরিমাণে দেশের সম্পদ লুঠতরাজ চালালে এবং জনগণের উপর কী তীব্রশোষণ চালালে এমন অবিশ্বাস্য হারে সম্পদ বাড়ানো সম্ভব এর মধ্যে কোথায় আম জনতার ‘আচ্ছে দিন’, আর কোথায় বা প্রধানমন্ত্রীর সব কা সাথ সব কা বিকাশ?
অথচ দেশে সত্যিই খাদ্যের অভাব নেই৷ ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের হিসেব, ভারতে প্রতি বছর খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হয় ২২.৫–২৩ কোটি টন৷ ২০১৬–১৭ সালে দেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৭.৩ কোটি টন৷ অর্থাৎ উৎপাদন হচ্ছে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি৷ ইউপিএ জমানায় খাদ্যমন্ত্রী শরদ পওয়ার সংসদে জানিয়েছিলেন, মজুত খাদ্যশস্যের প্রায় ৪০ শতাংশই পচে নষ্ট হয়৷ তবু ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে খাবার পৌঁছায় না৷ কারণ খাদ্যশস্যের একটা বিরাট অংশ মজুত করে একচেটিয়া কারবারি কর্পোরেট সংস্থাগুলি৷ চাষির হাত থেকে তাদের হাতে পৌঁছালেই এক লাফে তার দাম সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়৷ আর রয়েছে একদিকে সরকারের পুঁজিবাদী নীতি, অন্য দিকে চূড়ান্ত অব্যবস্থা, যার জন্য গুদামে পচে নষ্ট হলেও ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে তা পৌঁছায় না৷ এর নাম দেশের উন্নতি? এই উন্নতিরই তো জয়ঢাক বাজাচ্ছেন বিজেপি কংগ্রেস তৃণমূল সিপিএমের মতো শাসক দলগুলির নেতারা৷ সেই ঢাকের আওয়াজেই কি চিরকাল চাপা পড়ে থাকবে বিমলা পাণ্ডে, সন্তোষ কুমারীদের দু’মুঠো খেতে চাওয়ার আর্তি?
(৭১ বর্ষ ৪ সংখ্যা ২৪ আগস্ট, ২০১৮)