সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, ২০২১-’২২ সময়কালের প্রসূতি মৃত্যুর হার। স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরে দেশ যখন প্রযুক্তিতে অগ্রগতির শিখরে, ভারতীয় মহাকাশযান চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছে যাচ্ছে, দেশকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি বানানোর ঢাক পেটাচ্ছেন শাসকরা, সেই সময় দাঁড়িয়ে সন্তান প্রসবের মতো অতি স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক এবং শারীরবৃত্তীয়় একটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে গিয়ে এত বেশি সংখ্যক মহিলার মৃত্যু ঘটছে কেন?
একটা সময় ছিল যখন হাসপাতালে প্রসবের সংখ্যা খুবই কম ছিল। ২০০৫-এও প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের সংখ্যা ছিল ৪৩ শতাংশ, তখন এক লক্ষ জীবন্ত প্রসব পিছু সারা ভারতে ২৫০ জন মায়ের মৃত্যু হত। পশ্চিমবঙ্গে তখন এই মৃত্যুর হার ছিল ১৪০। ক্রমশ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার বাড়তে থাকে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে যা প্রায় ৯৭ শতাংশ এবং ভারতবর্ষের গড় বর্তমানে ৯২ শতাংশ। ২০১৮ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মাতৃমৃত্যুর হার ভারতবর্ষের গড় মাতৃমৃত্যুর হারের তুলনায় কম ছিল। কিন্তু লক্ষণীয়, ২০১৮-২০ সাল পর্যন্ত সারা ভারতবর্ষের মাতৃমৃত্যুর হার যখন কমতে কমতে প্রতি ১ লক্ষে ৯৭-এ এসে দাঁড়িয়েছে, তখন পশ্চিমবঙ্গের মাতৃমৃত্যুর হার আবার বেড়ে ১০৯ হয়েছে। সেই থেকে ২০২৫ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মাতৃমৃত্যুর হার ভারতবর্ষের গড় মাতৃমৃত্যুর হারের তুলনায় বেশিই থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সার্ভের (এসআরএস) ২০২০-২২ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে সারা দেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমে দাঁড়িয়েছে ৮৮, সেখানে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে মাতৃমৃত্যুর হার ১০৫।
মৃত্যুর কারণ
১) বর্তমানে যে সব কারণে মাতৃমৃত্যু ঘটে থাকে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হল প্রসবের পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। এক তৃতীয়াংশেরও বেশি মাতৃমৃত্যুর এটাই কারণ। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ জনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হচ্ছে– সঠিক পরিকাঠামোর অভাবে অথবা ট্রান্সফার হয়ে উন্নত পরিকাঠামো বিশিষ্ট হাসপাতালে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দেরি হওয়ার কারণে।
২) সমীক্ষায় দেখা গেছে বর্তমানে ভারতে ৫২ শতাংশের উপরে গর্ভবতী মহিলা মাঝারি থেকে মারাত্মক অ্যানিমিয়াতে ভোগে। আমাদের দেশে কিশোরীদের মধ্যে শতকরা ৬০ জন অ্যানিমিয়াতে ভোগেন। স্কুল স্তর থেকে আয়রন ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট খাওয়ানো থেকে শুরু করে গর্ভবতী মহিলাদের আয়রন ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট খাওয়ানোর কর্মসূচি থাকলেও গর্ভাবস্থায় ৫০ শতাংশের উপরে মহিলা মারাত্মক অ্যানিমিয়াতে ভোগেন। কারণ শুধুমাত্র আয়রন বড়ি খেয়ে অ্যানিমিয়া মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার রয়েছে প্রোটিন যুক্ত পুষ্টিকর খাবার। আমাদের দেশের অধিকাংশ মহিলা উপযুক্ত পুষ্টিকর খাবার না পাওয়ার ফলে শিকার হন অ্যানিমিয়ার। এ ছাড়াও নানা ধরনের ক্রনিক রোগের কারণে অ্যানিমিয়া তাঁদের সঙ্গী। আপামর মানুষের দৈনিক আয় ১৬৭ টাকারও কম। সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশেরই দিনে এক বেলা পেটভরা খাবার জোটে। পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য তারা পাবে কোথায়?
৩) এর পরে রয়েছে সেপসিস, এক্লেমশিয়া, অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি, জন্ডিস ইত্যাদি রোগের ঠিকমতো চেকআপের ব্যবস্থার অভাব।
প্রাক প্রসবকালীন চেক আপ এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নানা জটিলতা নির্ণয় করা সম্ভব এবং সময়মতো ব্যবস্থা নিলে প্রসবকালীন জটিলতাগুলো এড়িয়ে চলা যেতে পারে। প্রাক প্রসবকালীন ৪ টি চেকআপ এ জন্য জরুরি। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৪২ শতাংশ গর্ভবতী মহিলা প্রাক প্রসবকালীন ৪ টি চেকআপের সুযোগ পেয়ে থাকেন। চতুর্থ চেকআপের পরে এইসব গর্ভবতী মহিলাদের খোঁজ রাখার মতো সরকারি ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে চতুর্থ চেকআপ পর্যন্ত গর্ভবতী মহিলারা স্বাভাবিক থাকলেও পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ প্রসবের আগে পর্যন্ত তাদের নানা শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে। কিছু ক্ষেত্রে নানা জটিলতা দেখা দেয়। সেই সবগুলো প্রাথমিকভাবে নির্ণয় করার মতো পরিকাঠামো রাজ্য সরকারের নেই। ফলে জটিলতা এড়ানো যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রাক প্রসবকালীন পরিষেবা দেওয়ার পরিকাঠামো, যন্ত্রপাতির গুণমান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো যথাযথ রাখার ক্ষেত্রে রয়েছে স্বাস্থ্য দপ্তরের অবহেলা।
পশ্চিমবঙ্গে মাতৃমৃত্যুর ওপর সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যত মাতৃমৃত্যু হচ্ছে তার মধ্যে ৭০ শতাংশই সিজারের পরে হচ্ছে। সিজার পরবর্তী মৃত্যুর হার এসে দাঁড়িয়েছে এক লাখে ৩৩৮। দেখা গেছে পরিকাঠামো এবং দক্ষ ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব রয়েছে সর্বত্রই। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি অপারেশন থিয়েটার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ওয়ার্ড নিয়মিতভাবে পরিশোধিত করা হয় না। বহু ক্ষেত্রে সিনিয়র চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতেই জুনিয়র চিকিৎসকরা অপারেশন করতে বাধ্য হন। অপারেশন পরবর্তী পরিচর্যা যথেষ্ট গুণমান সম্পন্ন হয় না। বহু ক্ষেত্রে প্রসূতি মা সঠিক পরিচর্যা পানও না, ফলে সেপসিস, অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি ইত্যাদির মতো অত্যন্ত মারণ সমস্যাগুলি দেখা দেয়। বহু ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। কলকাতার এসএসকেএম-এর মতো দু’একটি হাসপাতালকে বাদ দিলে রাজ্যে আর কোথাও কার্যত এই ধরনের জটিলতা চিকিৎসা করার পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। প্রসূতিদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ওষুধপত্রের নিম্ন গুণমান এবং ভেজাল ওষুধ মাতৃমৃত্যুর হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। সম্প্রতি মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজে নিম্নমানের স্যালাইনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে দুজন প্রসূতির মৃত্যু ঘটেছে।
নাবালিকা বিবাহ বৃদ্ধি
সম্প্রতি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যত প্রসূতির মৃত্যু ঘটছে তার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যায় রয়েছে কিশোরী মায়েরা। বাল্যবিবাহ বর্তমানে একটা সামাজিক অভিশাপ। অর্থনৈতিক চূড়ান্ত বিপর্যয় এবং সাংস্কৃতিক জগতের চূড়ান্ত অবক্ষয় আজ বাল্যবিবাহের সংখ্যা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে কৈশোর পেরোনোর আগেই গর্ভধারণ বাড়ছে। বাল্যবিবাহের নিরিখে দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, ত্রিপুরার ঠিক পরে পরে। কিশোরী গর্ভধারণের হারও এ রাজ্যে অনেক বেশি। প্রায় ২৪ শতাংশ গর্ভবতী মহিলাই কিশোরী। অপুষ্টি, রক্তাল্পতায় ভোগা এবং অসম্পূর্ণ শারীরিক গঠনের জন্য এই বয়সে গর্ভধারণ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং এদের মধ্যে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদি নানা রকমের ভোটসর্বস্ব চটকদার সামাজিক পরিকল্পনা চালু করা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক চূড়ান্ত সংকট এবং সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এই কিশোরী গর্ভধারণের মতো শোচনীয় পরিণতিকে আটকাতে পারছে না।
কী করণীয়?
মাতৃমৃত্যু কমাতে চাই যথাযথ সরকারি সদিচ্ছা। সরকার যতদিন মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা না দেবে, তত দিন এ সমস্যা নির্মূল করা কঠিন। কিন্তু, পুঁজিবাদী শাসনে মানুষকে দেখা হয় লাভের পণ্য হিসাবে। ফলে জনস্বার্থে বরাদ্দ যথাযথ নয়। পূর্বতন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় বা সোসালাইজড মেডিসিন যে সব দেশে চালু হয়েছিল সে সব দেশের সরকার মানুষকে সম্পদ হিসেবে গণ্য করার নীতি গ্রহণ করেছিল। চিকিৎসা ছিল বিনামূল্যে। আমাদের সরকারও যতদিন জনগণকে সম্পদ হিসেবে গণ্য না করবে, তত দিন মাতৃমৃত্যুর মতো অনাকাঙিক্ষত ঘটনা কমানো সম্ভব হবে না। কিন্তু সরকারকে জনমুখী নীতি গ্রহণে বাধ্য করতে হলে দরকার ধারাবাহিক নাগরিক আন্দোলন।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা ২৭ জুন – ৩ জুলাই ২০২৫ এ প্রকাশিত