সম্প্রতি ‘তরুণের স্বপ্ন’ নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির প্রতি ছাত্রের অ্যাকাউন্টে ১০,০০০ টাকা দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা দপ্তর। বিগত কয়েক দিনে বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই টাকা হয় ভুল অ্যাকাউন্টে অথবা প্রতারকদের অ্যাকাউন্টে পৌঁছানোর খবর প্রকাশিত হতেই নতুন আরও এক দুর্নীতি সামনে এসেছে। এখনও পর্যন্ত যা জানা গেছে তাতে ৭০ লক্ষ টাকারও বেশি হাতিয়ে প্রায় ১২০০ ভুয়ো অ্যাকাউন্টের হদিশ মিলেছে। এই কাণ্ডের জন্য বিভিন্ন সাইবার ক্যাফের মালিক, প্রাথমিক শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, হ্যাকার সহ প্রায় ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন প্রতারকের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। জানা নেই এই দুর্নীতির শেষ প্রান্তে কে বা কারা অপেক্ষা করছে। এও দেখা যাচ্ছে, ধৃতদের মধ্যে একটা বড় অংশ বিভিন্ন জেলায় শাসক তৃণমূলের সাথে যুক্ত। সাম্প্রতিক সময়ে এ রাজ্যে শিক্ষা-স্বাস্থ্য সহ অন্য বহু ক্ষেত্রে একের পর এক দুর্নীতি ঘটছে এবং তার অভিযোগে শাসকদলের একাধিক নেতা-মন্ত্রীকে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছে, তা তো কারও অজানা নয়। স্বভাবতই ট্যাব দুর্নীতির দায়ভারও নিশ্চয়ই তৃণমূল সরকার এড়িয়ে যেতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী যখন এই ঘটনার জন্য ঝাড়খণ্ড-বিহারের বিভিন্ন চক্র বা জামতাড়া চক্রকে দায়ী করছেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই ভুলে যাবেন না যে তার দলের কয়েকজন কর্মীর নামও এই জালিয়াতিতে সামনে এসেছে।
প্রশ্ন হল, গত বছর থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রদের জন্য এবং এই বছর তার সাথে একাদশ শ্রেণির ছাত্রদের যুক্ত করে কেন সরকার ট্যাব কেনার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল? ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সহ পশ্চিমবঙ্গের সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার যে চূড়ান্ত দুরবস্থা তা কি একটা ট্যাব দিয়ে পুনরুদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে? ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, ট্যাবের টাকা পাওয়ার পরেই অনেক স্কুলেই বেশ কিছু ছাত্র উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা দেয়নি। এই ছাত্ররা যে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে না তা সহজেই অনুমান করা যায়। বোঝা যাচ্ছে, অভাবগ্রস্ত পরিবারে কিছুটা সরকারি খয়রাতি পেতে বহু ছাত্র স্কুলের খাতায় নাম লিখিয়েছিল, যারা টাকা পাওয়ার পরে স্কুলছুট হয়ে গেল। এই ছাত্র-ছাত্রীদের বাবা-মায়েরা জানেন ছেলেমেয়েদের শিক্ষা তাদের কাছে বিলাসিতা। তাই সমস্ত স্বপ্নকে পদদলিত করে তারা ছেলেমেয়েদের অপরিণত বয়সেই কাজে যুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়। বাড়তে থাকে স্কুলছুটের সংখ্যা। ভাবুন তো, এই পরিবারগুলির অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যতিরেকে ট্যাব বা কন্যাশ্রী-যুবশ্রীর মতো কিছু খয়রাতি দিয়ে আদৌ কি শিক্ষার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব? যে ছাত্ররা ট্যাব কেনার টাকা পেয়ে টেস্ট পরীক্ষা দিল না তারা অনেকেই হয়ত টাকা পাওয়ার প্রতিদান হিসেবে হয়ত শাসক দলকে ভোট দেবে, কিন্তু কোনও দিন আর স্কুলমুখী হবে না– সরকার এর সামাজিক অভিঘাত কি বুঝেছে আদৌ? যে ব্যবস্থার কল্যাণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তার স্থায়ী সমাধানে শিক্ষার পরিকাঠামোকে ঢেলে সাজানো, পর্যাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করা, শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো সহ অন্যান্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। বরং ক্রমাগত সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেওয়ার আয়োজন চলছে।
দেখা যাচ্ছে ট্যাবের টাকা যেমন ঢুকেছে অনেকদিন আগে পাশ করে যাওয়া কোনও ছাত্রের অ্যাকাউন্টে আবার এই টাকা ঢুকেছে লক্ষ্মীর ভান্ডার বা ১০০ দিনের কাজের জন্য খোলা অ্যাকাউন্টে। বোঝা যায়, একদিকে যেমন ভুল তথ্যের কারণে এই কেলেঙ্কারি ঘটেছে– আবার রাজ্যজুড়ে হ্যাকার বা দুষ্টচক্রের সক্রিয় কার্যকলাপও এইকেলেঙ্কারির পিছনে কাজ করেছে। এক্ষেত্রে সরকারি টাকা নির্দিষ্ট ছাত্রদের অ্যাকাউন্টে পৌঁছানোর মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য যেমন দায়িত্ববোধের ঘাটতি রয়েছে সর্বস্তরে, তেমনি যে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো দরকার ছিল তার অভাব রয়েছে বলে প্রায় সব স্কুল জানিয়েছে।
সরকারি স্কুলগুলিতে অশিক্ষক কর্মীর অভাব থাকার ফলে বহু স্কুলেই কম সময়ে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীদের নাম সরকারি পোর্টালে তুলতে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা অসম্ভব চাপে পড়েছেন এবং তার জন্য ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করে নিয়েছে বহু স্কুল কর্তৃপক্ষ। আবার অনেক স্কুলেই এই কাজের পরিকাঠামো না থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের যেতে হয়েছে বাইরের সাইবার কাফেতে। প্রধান শিক্ষকরা জানিয়েছেন যে, স্কুলগুলিতে প্রায় ১৭টি সরকারি প্রকল্প চলে, অথচ ডাটা এন্ট্রির জন্য স্কুলগুলিতে একজন স্টাফও নেই। স্কুলগুলির এই বিপুল সংখ্যক শূন্যপদে কোনও নতুন নিয়োগ হচ্ছে না। এই ভুলের দায়ভার পুরোপুরি রাজ্যের শিক্ষাদপ্তর তথা রাজ্য সরকারকেই নিতে হবে।
অন্যদিকে, ‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্কুল ও শিক্ষাদপ্তরের স্তরে স্তরে যে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও ফাঁক থেকে গেছে এবং তা এতই প্রকট যে জালিয়াতরা অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এ ক্ষেত্রেও তার সুযোগ নিতে বিলম্ব করেনি। টাকা হাতাতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা ১০০ দিনের কাজের অ্যাকাউন্ট ভাড়া নেওয়া হয়েছে কমিশন দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে। যোগ্য ছাত্রের জায়গায় ভাড়া নেওয়া অ্যাকাউন্টগুলির নাম্বার ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ করেছে সাইবার কাফেগুলি। ভাড়া নেওয়া অ্যাকাউন্টগুলিতে টাকা ঢোকার পরে এটিএম-এর মাধ্যমে তা তুলে নেওয়া হয়েছে কমিশনের টাকা বাদ রেখে। ভেবে দেখুন, এই ধরনের একটা জালিয়াত চক্র রাজ্যে সক্রিয় হয়ে উঠল, তারা গরিব মানুষের অ্যাকাউন্ট ভাড়া নিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফাঁদ পাতল, বেশ কিছুদিন যাবৎ তারা সরকারি পোর্টাল ব্যবহার করল– অথচ পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তর থেকে শুরু করে স্কুল কর্তৃপক্ষ, সরকার, শিক্ষা দপ্তর, প্রশাসন কেউ কিছু জানতে পারল না। আদৌ কি এটা বিশ্বাসযোগ্য? ঝাড়খন্ড-বিহার চক্র বা জামতাড়া চক্রের উপর দায় চাপিয়ে দিলেই কি মুখ্যমন্ত্রী দায়মুক্ত হতে পারবেন? ‘তরুণের স্বপ্ন’ কী করে ‘দুঃস্বপ্নে’ পরিণত হয়ে গেল, এর জন্য প্রকৃত দোষী কারা বা স্কুলের লগ ইন আইডি এবং পাসওয়ার্ড কীভাবে বাইরের হ্যাকাররা পেল– তার উত্তর তো সরকারকে দিতে হবে।
এ ধরনের ঘটনা কেন এ রাজ্যে বারবার ঘটছে বা ভারতের অন্য রাজ্যগুলিতে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প নিয়ে জালিয়াত চক্রকে সক্রিয় হতে কেন বারবার দেখা যাচ্ছে– তার উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে একটু গভীরে গিয়ে। বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলগুলি মসনদে টিকে থাকার স্বার্থে ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করার উদ্দেশ্যে মানুষের বেঁচে থাকার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু টাকা খয়রাতি দিচ্ছে। এই টাকায় যেমন মানুষের দারিদ্রের কোনও লাঘব হচ্ছে না, তেমনি নিজেদের অধিকারবোধ ভুলে গিয়ে মানুষ এই দলগুলির লেজুড়বৃত্তি করে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে বেড়াচ্ছে। আবার এই প্রকল্পগুলি সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামোর উন্নয়নে কোনও পদক্ষেপ করছে না সরকারগুলো। এ ক্ষেত্রে যে নূ্যনতম দায়িত্বজ্ঞান থাকা দরকার তার ছিটেফোঁটাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং এই ফাঁকের সুযোগ নিয়ে জালিয়াতরা অবাধে তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। বহু ক্ষেত্রেই এরা শাসকদলের সাথে সরাসরি যুক্ত রয়েছে অথবা শাসকদলের নেতা মন্ত্রীদের হাত এদের মাথার উপরে থাকায় এদের বিরুদ্ধে কোনও কঠোর ব্যবস্থা নিতে অপারগ প্রশাসন। মিথোজীবীর মতো এরা শাসকদের সাথে সর্বত্র আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। তাই এই ভোটবাজ দলগুলির স্বরূপ চিনতে পারা এবং এদের অন্যায়-নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে সোচ্চার হওয়া আশু প্রয়োজন।