গত ৭১–৪২ সংখ্যার গণদাবীতে প্রকাশিত ‘দিশাহীন হয়েই সিপিএম নেতা–কর্মীরা বিজেপির পক্ষে দাঁড়ালেন’ নিবন্ধটিতে একটি অপ্রিয় সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে, যা আশা করি বামপন্থী মহলের উদারমনা অংশকে ভাবিয়েছে৷ এই প্রসঙ্গে আরও দু–চারটি কথা উল্লেখ করছি৷
পঞ্চাশের দশকে এ রাজ্য বামপন্থী আন্দোলনে উত্তাল ছিল৷ হাজারে হাজারে মানুষ সেদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে সামিল হতেন৷ পুলিশি অত্যাচারকে উপেক্ষা করে খাদ্যের দাবিতে, ট্রামের ভাড়াবৃদ্ধির বিরুদ্ধে এই মানুষেরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেন, মিছিলে সামিল হতেন, স্লোগানে গলা মেলাতেন, পুলিশের লাঠি–বন্দুকের সামেনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতেন৷ তাঁরা স্বপ্ন দেখতেন রাশিয়া ও চীনের সমাজতন্ত্রের৷ যেখানে খাদ্য–সংকট ছিল না৷ বেকারি ছিল না, মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ ছিল না৷ এই ছিল সেদিনের স্বপ্নের বামপন্থা৷ জওহরলালের দুঃস্বপ্নের নগরী কলকাতা৷
সেদিন বড় পার্টি হিসাবে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দৌলতে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিটি ছিল এই আন্দোলনের নেতৃত্বে, স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে৷ কিন্তু নেতৃত্বে থাকলেও দলটির সঠিক সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও মার্কসবাদী বিচার–বিশ্লেষণ ক্ষমতা না থাকার ফলে বামপন্থী আন্দোলনের স্বপ্ন পূরণের সেই লক্ষ্যে তারা নিয়ে যেতে পারল না৷ শুধু কংগ্রেসের অন্ধ বিরোধিতা, যুক্তিহীন অন্ধ আবেগ এবং সংগ্রামের স্বতঃস্ফূর্ততাকে মূলধন করে তাঁরা আন্দোলন পরিচালনা করলেন৷ লড়াইয়ের বিপুল আত্মত্যাগে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভকে চালিত করা হল ভোটমুখী করে৷ তাতে বামপন্থীদের আসন বৃদ্ধি পেল, কিন্তু লড়াইয়ে সামিল হওয়া মানুষগুলি পেলেন না শ্রেণি চেতনা, বিপ্লবী শিক্ষা৷
সিপিআই ভেঙে সিপিএম হলেও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হল না৷ ছোট দল হলেও মহান মার্কসবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষের হাতে গড়ে ওঠা এস ইউ সি আই (সি)–র সঠিক সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সেদিনের বামপন্থী আন্দোলনের একটা সংঘাত ছিল৷ যুক্ত বামপন্থী আন্দোলনের আদর্শগত পরিমণ্ডলে এই দুই লাইনের দ্বন্দ্ব ছিল৷ এস ইউ সি আই (সি) চেয়েছিল গ্রামে শহরে কারখানায় আন্দোলনের গণকমিটি গঠন করার মধ্য দিয়ে লড়াইকে দীর্ঘস্থায়ী করতে এবং লড়াইয়ে আসা হাজার হাজার মানুষগুলির আবেগকে সংহত করে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিতে, যা সমাজের অভ্যন্তরের শ্রেণি সংগ্রামকে তার কাঙিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে৷
আদর্শগত এই সংগ্রাম সবচেয়ে ফুটে উঠেছিল রাজ্যের যুক্তফ্রন্ট সরকার পরিচালনার দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে৷ এস ইউ সি আই (সি) আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা যুক্তফ্রন্ট সরকারকে আন্দোলনের পরিপূরক হিসাবে পরিচালনা করতে চেয়েছিল৷ তারা ‘ন্যায়সঙ্গত গণআন্দোলনে পুলিশ হস্তক্ষেপ করবে না’ – এই নীতি ঘোষণা করতে যুক্তফ্রন্টকে বাধ্য করেছিল এবং শ্রমিক আন্দোলনে ‘ঘেরাও’ চালু করে শ্রেণিসংগ্রামকে এক নতুন উচ্চতর মাত্রা দিয়েছিল৷ সেদিন সিপিএম এই নীতি মেনে নিতে পারেনি৷
বাম আন্দোলনে অবিভক্ত সিপিআই এবং পরবর্তী কালে সিপিএমের অবাম দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে আদর্শগত ক্ষেত্রে এস ইউ সি আই (সি) নিরবচ্ছিন্নভাবে তার সমালোচনা প্রকাশ্যে বামপন্থী জনসাধারণের কাছে তুলে ধরেছিল৷ কিন্তু সিপিএম এটাকে ‘কুৎসা’ আখ্যা দিয়ে ‘যুক্ত আন্দোলনে থাকতে হলে এই সমালোচনা বন্ধ করতে হবে’– শর্ত দিয়ে এস ইউ সি আই (সি)–কে যুক্ত আন্দোলনের বাইরে থাকতে বাধ্য করে৷ বামপন্থী আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা সেদিনের অবিভক্ত সিপিআই–এর সাম্যবাদী চিন্তা প্রক্রিয়া ছিল না, কিন্তু একটা সংগ্রাম ছিল, যেটা শ্রমজীবী মানুষকে আকর্ষণ করেছিল৷ এর সাথে আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের স্বীকৃতি ও প্রভাব কাজ করছিল৷ আজ তার বামপন্থী সত্তা বলতে থেকে গিয়েছে ঝান্ডার লাল রঙ এবং নির্বাচনী প্রতীক কাস্তে হাতুড়ি তারা৷ হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার গল্পের মতো যে বিরাট সংখ্যক মানুষ সেদিন তাদের ভুল নেতৃত্বকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলছিল, তাদের কাছে বামপন্থা আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সংসদীয় ব্যবস্থায় একটা বামপন্থী বিকল্প তৈরি করা৷ লড়াই, শ্রেণিসংগ্রাম তার একটা বুলি মাত্র৷
জার্মানির হ্যামলিন শহরের কিশোর–কিশোরীরা বাঁশিওয়ালার সুরের মুগ্ধতায় তাকে অনুসরণ করে পাহাড়ের গহ্বরে ঢুকে গিয়ে যেভাবে প্রাণ হারিয়েছিল, তেমনি বামপন্থী আন্দোলনের এক সময়ের স্বপ্ন–আবেগও শ্রেণিসংগ্রামের সঠিক দিশা হারিয়ে সংসদীয় রাজনীতির চোরাবালিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে৷ যদিও এই দীর্ঘ যাত্রাপথে এস ইউ সি আই (সি)–র সঠিক সাম্যবাদী চিন্তা–প্রক্রিয়ার সংগ্রামী বামপন্থার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তার সংঘাত ঘটেছে৷ বামপন্থী আন্দোলনে এই দুই লাইনের দ্বন্দ্বের ইতিহাসটা আজ সামনে আনা দরকার৷ তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে এই বিষয়ে একটি লেখা ছাপা হলে ভাল লাগবে৷
তপন চক্রবর্তী
বেহালা পশ্চিম, কলকাতা৷