সমাজবাদী পার্টির এক সাংসদের আরএসএস সংক্রান্ত কিছু তথ্যের প্রসঙ্গে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড় সম্প্রতি বলেছেন, আরএসএস ভারতের ইতিহাসে সেবা ও আত্মত্যাগের জন্য স্মরণীয়। তার সমালোচনা করা অন্যায়, অসাংবিধানিক। রীতিমতো রুলিং জারি করে তিনি আরএসএস সদস্যদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছেন। এর আগে তিনি একইভাবে মল্লিকার্জুন খড়েগর আরএসএস সম্পর্কিত মন্তব্য সংসদের রেকর্ড থেকে মুছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ধনখড়জির এই ভূমিকা কি গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? আরএসএস- কে নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি থাকতেই পারে। সংগঠনটি নিয়ে তিনি স্পর্শকাতর হতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিগত দিক। কিন্তু এই সংগঠনটির কাজ-কর্ম নিয়ে গণতন্ত্রের উচ্চতম প্রতিষ্ঠান সংসদে কোনও আলোচনা করা যাবে না– এই ফতোয়া তো স্বৈরতন্ত্রের প্রতিধ্বনি! রাজ্যসভার মতো ফোরামের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর নিরপেক্ষতা প্রত্যাশিত। এটা রক্ষা করা তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব। দুর্ভাগ্য, তাঁর আচরণে সেটা দেখা যাচ্ছে না।
তিনি আসলে আরএসএসের ধাঁচেই চলছেন। আরএসএস-এর কর্মপদ্ধতি হল ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তাকে হত্যা করা। রা’ষ্ট্রের ছাঁচে ফেলে মানুষকে শাসকের অনুগত দাসে পরিণত হওয়ার ট্রেনিং দেয় আরএসএস। দেশের প্রকৃত সমস্যা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা বিশেষ নেই। বেকারত্ব বা বৈষম্য বাড়ল না কমল, মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতিতে জনগণের হাল কী দাঁড়াল, কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পেল কি না শ্রমিকদের উপর কাজের বোঝা কতখানি চাপল, মজুরি কতখানি কমিয়ে দেওয়া হল তা নিয়ে তারা চিন্তিত নয়।
অথচ এগুলিই আজ আমাদের দেশে মূল জাতীয় সমস্যা রূপে অবস্থান করছে। যারা জাতির উন্নতি বা সেবায় নিয়োজিত বলে দাবি করবে, তারা এই সমস্যাগুলি সমাধানে মাথা ঘামাবে না? এ দেশের নবজাগরণ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের সমস্ত বড় মানুষদের আমরা দেশের এই সমস্যাগুলি নিয়ে ভাবতে এবং পরিপূরক ভূমিকা নিতে দেখেছি। মানুষকে সমস্ত প্রকার শোষণ থেকে মুক্ত করে সমাজে বৈজ্ঞানিক, গণতান্ত্রিক ও যুক্তিবাদী চেতনা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে সেদিন তাঁরা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন সেটাই ছিল সমাজে তাঁদের বিশিষ্ট মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার মূল পাথেয়। আরএসএসের কোনও নেতা বা কর্মকর্তাকে এই ধরনের ভূমিকায় কি কোনও দিন কেউ দেখেছে? আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকার দেশের সিংহভাগ গরিবের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির সম্পদ বৃদ্ধির নীতি প্রণয়ন করে চলেছে। ধনখড়জি যখন আরএসএসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন আরএসএস কী ভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে জাতিকে সেবা করে চলেছে, তা যদি তিনি বলে দিতেন মানুষের বড় উপকার হত।
আরএসএস-এর মডেলে বিজেপি জমানায় দেশে প্রাচীন ঐতিহ্য জানার নামে ধর্মীয় শিক্ষা, আধ্যাত্মিকতা, কুসংস্কার প্রভৃতির প্রসার ঘটানো হচ্ছে। সর্বস্তরে ইতিহাস বিকৃত করা,পুরাণকে ইতিহাস হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া, যথার্থ ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিকে বাদ দেওয়া প্রভৃতি ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। নবজাগরণ, জাতীয়তা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের জন্ম হয়েছে বহু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তার মধ্যেও আছে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির সুস্পষ্ট ছাপ। আরএসএস যে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জাতীয়তার কথা বলে, সেটা আসলে কৃত্রিমভাবে দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া একটা বিষয়। ভারতীয় জাতি গড়ে ওঠার দীর্ঘ ইতিহাস বলে, বহু জাতিসত্তা, বিভিন্ন ধর্মীয় মানুষ, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির উত্তরাধিকার মিলে ভারতীয় পরিচয় গড়ে উঠেছে। একমাত্রিক ছাঁচে ঢালা হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির ফরমুলা কোনও মতেই ভারতীয় বলে চালানো যায় না। ধনখড়জির জেনে রাখা ভাল, ভারতীয় জাতীয়তাবোধ ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়েই একদিন এ দেশে গড়ে উঠেছিল। ইতিহাস বলছে, আরএসএস ছিল এই ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী। জাতীয়তাবাদ নিয়ে আরএসএসের গুরু গোলওয়ালকরের মন্তব্য নিশ্চয়ই ধনখড়জির জানার কথা। গোলওয়ালকর তাঁর ‘উই অর আওয়ার নেশানহুড ডিফাইন্ড’ বইতে পরিষ্কার বলছেন ‘হিন্দুরা স্মরণাতীত কাল থেকে এ মাটির সন্তান এবং এ দেশের স্বাভাবিক প্রভু’। এই চিন্তা এ দেশের গৌরবোজ্জ্বল গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সংগ্রামী ঐতিহ্যের পরিপন্থী। এই গোলওয়ালকর স্বাধীনতা আন্দোলনের যোদ্ধাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ব্রিটিশরা যে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি চেয়েছিল তার অন্যতম মদতদাতা ছিল এক দিকে মুসলিম লিগ অন্যদিকে হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস। ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে আরএসএস যোগ দেয়নি। ১৯৩৯ সালে সাভারকর গোপনে ভাইসরয়কে জানিয়েছিলেন যে ‘ব্রিটিশ ও হিন্দুদের পরস্পর বন্ধু’ হওয়া উচিত। আমাদের দেশে সংবিধান স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে গোলওয়ালকর তাঁর ‘বাঞ্চ অফ থটস’রচনায় পদে পদে বিরুদ্ধতা করেছিলেন। তার মত ছিল সকলের হিন্দুত্বকে মেনে নেওয়াই হল ধর্মনিরপেক্ষতা। যেহেতু হিন্দু জাতীয়তাবাদকেই আরএসএস সঠিক বলে মনে করে, তাই সেই সময় আরএসএস স্বাধীনতা আন্দোলন বয়কট করেছিল। আরএসএসের চোখে দেশবন্ধু, নেতাজি, লালা লাজপত রাই, গান্ধীজি, ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, সূর্য সেনরা ছিলেন বিশ্বাসঘাতক ও দেশের শত্রু। এই হচ্ছে আরএসএসের জাতীয় অগ্রগতিতে নিয়োজিত থাকার নমুনা। ধনখড়জির ‘রুলিং’ মেনে আরএসএস-এর মতো মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক সংগঠনকে দেশসেবার দায়িত্ব দিলে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের যতটুকু ছিটেফোঁটা রয়েছে তা যে পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
আরএসএসের মদতে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ও ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। এ দেশের যুক্তিবাদী, বৈজ্ঞানিক, সংগ্রামী ঐতিহ্যকে ধবংস করে দেশকে ধর্মান্ধ মধ্যযুগীয় অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। আর এ সবই কেন্দে্রর বিজেপি সরকার করে চলেছে আরএসএসের নির্দেশেই।
আজ সমগ্র দেশ যখন বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, চুরি, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, ক্ষুধা, আত্মহত্যা, শিশু মৃত্যু সহ বিভিন্ন সমস্যায় বিপর্যস্ত, তখন এ দেশের মহান মনীষীদের স্বপ্নকে সামনে রেখে যুগোপযোগী আদর্শকে পাথেয় করে ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-প্রদেশ নির্বিশেষে সকল মানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই একমাত্র দেশ তথা জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঠিক লক্ষ্য পূরিত হওয়া সম্ভব। এর বিপরীতে পুঁজিপতিদের আড়াল করতে মানুষের ঐক্যকে বিনষ্ট করে এবং বিজ্ঞান ও যুক্তিকে ধ্বংস করে দেশকে ফ্যাসিবাদের দিকে নিয়ে যাওয়াই হল আরএসএস তথা বিজেপির লক্ষ্য।