১৯ জুলাই, ঘড়ির কাঁটা দুপুর দেড়টা ছুঁয়েছে৷ কলকাতার রাজভবনে আছড়ে পড়ল উত্তাল বিক্ষোভের ঢেউ৷ উচ্চকিত স্লোগানে গমগম করে উঠল গোটা এলাকা– অবিলম্বে প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালু কর৷ পরিবর্তে নেমে এল নির্মম পুলিশি অত্যাচার৷ আহত হলেন শতাধিক মানুষ৷ গণতন্ত্র পায়ে মাড়িয়ে শাসকেরা আবার রক্তাক্ত করল কলকাতার রাজপথকে৷
হাজারের বেশি মানুষ এসেছিলেন প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল প্রথা চালুর দাবি নিয়ে৷ সরকার বারবার কথা দিয়েও টালবাহানা করছে৷ গরিব–মধ্যবিত্ত ঘরের ছাত্ররা ক্লাসের পর ক্লাস পার হয়ে যাচ্ছে, অথচ শিখছে না কিছুই৷ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা৷ তাই এসেছেন তাঁরা বধির সরকারের কাছে উচ্চকণ্ঠে দাবি পৌঁছে দিতে৷ দেখা গেল রাজভবনের উত্তর, পূর্ব আর দক্ষিণ তিনটি গেটেরই দখল নিয়ে নিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা, লাগিয়ে দিয়েছেন ব্যানার– রাজভবন ঘেরাও৷ থমকে গেছে পাশের রাস্তার যানবাহন৷
উত্তর গেটের আশেপাশের অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছেন কর্মচারীরা৷ স্লোগান শুনে বলছেন, আর কতদিন সরকার টালবাহানা করবে? স্কুলে লেখাপড়া তো শেষ হয়ে গেল চলুক ঘেরাও৷ পূর্ব দিকের গেটের পাশে রাস্তায় অবরোধে আটকে পড়া বাসের যাত্রীরাও সমর্থন জানিয়েছেন আন্দোলনের দাবির প্রতি৷ মার্কস–এঙ্গেলস বীথি ছাড়িয়ে রেড রোড পশ্চিমে বাঁক নিয়েই আবার অবরুদ্ধ– দক্ষিণ গেটেও চলছে যে একই বিক্ষোভ৷ সময় গড়িয়ে দেখতে দেখতে আধঘন্টার বেশি কেটে গেছে, প্রখর রোদ আর গায়ে জ্বালা ধরানো আর্দ্র গরমে কষ্ট হচ্ছে সকলেরই৷ তবু সাধারণ পথচারী থেকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিক্ষোভকারী কেউই আন্দোলন ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন না৷ উত্তর গেটের সামনে মহিলারা বসে পড়েছেন৷ স্লোগান চলছে, মাঝে মাঝে কেউ খালি গলাতেই উপস্থিত জনগণকে সম্বোধন করে বক্তব্য রাখছেন৷ পুলিশ এতক্ষণে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ঘেরাও তুলতে পারেনি৷
হঠাৎ পুলিশ বাহিনীর মধ্যে চাঞ্চল্য৷ দেখে উপস্থিত সাধারণ মানুষ অনেকে ভাবছেন, এবার তাহলে বোধহয় কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারের প্রতিনিধি রাজ্যপালের মাধ্যমে সরকার কোনও সমাধানের বার্তা দিতে নির্দেশ দিয়েছে৷ পোস্টাল বিভাগের এক কর্মচারী তো বলেই ফেললেন, সরকার বোধহয় অলোচনা করবে বিক্ষোভ থেকে কি প্রতিনিধি পাঠাতে বলবে? গণতন্ত্রে তো এমনটাই হওয়ার কথা!
কিন্তু না! দেখা গেল গণতন্ত্রের তথাকথিত পূজারিরা বিশ্বাস করে শুধু লাঠি আর বন্দুকের জোরকেই৷ ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলিশ বাহিনী৷ নারী–পুরুষ নির্বিশেষে চলল নির্মম মার৷ এমনকী দক্ষিণ গেটে ষাটোর্ধ্ব এক মানুষ শান্তভাবে পুলিশের সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে জানাচ্ছিলেন প্রতিবাদ৷ লাঠির জোরে মাথা ফাটিয়ে ড্রেনে ফেলে চলল তাঁর উপর নির্যাতন৷ তবুও রক্তঝরা মাথা উঁচু করেই স্লোগান দিয়েছেন তিনি৷ পূর্ব গেটে তিন–চারজন পুলিশ মিলে এক–একজনকে টানছে৷ তার সাথে চলছে লাঠি বৃষ্টি, সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ৷ তবু বিক্ষোভকারীদের নড়াতে পারেনি পুলিশ৷ এক যুবককে রাস্তা দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে যেতে ‘মার ডান্ডা মার’ বলে পুলিশ যথেচ্ছ লাঠি চালাচ্ছে তাঁর মাথা–পা–পিঠ লক্ষ্য করে৷ তাঁকে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার করলেন অন্যেরা, দেখা গেল তিনি এক তরুণ চিকিৎসক৷ পেশার ঘেরাটোপ ছেড়ে এসেছেন রাজপথের বিক্ষোভে৷ হাত ধরেছেন শ্রমিক–চাষি–খেটে খাওয়া মানুষের৷ পথচারী ও বাসযাত্রীরা অনেকেই এই নির্মমতা দেখে চিৎকার করে পুলিশ অফিসারদের উদ্দেশে বলেছেন, এরা কি চোর–ডাকাত–গুন্ডা! মারছেন কেন?
মারতে মারতে মাথা ফাটিয়ে দিয়ে, হাত–পা ভেঙে দিয়েও যেন ক্ষান্ত নয় পুলিশ৷ পা–কোমর সহ নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লাঠির ঘা পড়ছে, মহিলা কর্মীদের শরীরের কোনও অংশই এই বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি৷ ফটো তুলতে গেলে ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে পুলিশ৷ অন্দোলনকারী অনেককেই টেনে–হিঁচড়ে মাটিতে ফেলে, পা দিয়ে ঠেলে, চ্যাংদোলা করে প্রিজন ভ্যানে তুলতে তুলতে হিংস্র উল্লাসে চেঁচিয়েছে তারা৷ ট্রাম লাইন ধরে টানতে টানতে আধ কিলোমিটার রাস্তা নিয়ে গিয়ে গ্রেপ্তার করেছে৷ এমনকী পুলিশের মারে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মহিলা কর্মীকেও গ্রেপ্তার করেছে৷ শুধু ঘেরাও তোলা নয়, আন্দোলকারীদের মারাটাই যে উদ্দেশ্য, তা বোঝা গেল রাজভবনের গেটের উল্টোদিকে রাস্তা পেরিয়ে এসইউসিআই(সি) কর্মীদের পিছনে মারমুখী হয়ে পুলিশকে ছুটতে দেখে৷ ঘটনাস্থল থেকে অনেকটা দূরে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে মাধাই হালদারের শহিদ বেদির কাছে এসে পুলিশ তাঁদের ঘিরে ধরে বেধড়ক পিটিয়েছে, এমনকী গ্রেপ্তারের পর গাড়িতে তুলেও চলেছে অকথ্য অত্যাচার৷ এদনি গ্রেপ্তার হন ১৬৪ জন৷ পুলিশ ও RAF এর আক্রমণে আহত ১১৭, গুরুতর আহত ১৮ জন৷
একটা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন,যেখানে একখণ্ড কাগজ কিংবা একটা ব্যানার ছাড়া কারও হাতেইকিছু ছিল না, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের মারমুখী হয়ে ওঠার কারণ কী? বিশেষত যেখানে এমন দাবিতে এই আন্দোলন, যে বিষয়ে পুলিশ কর্মীদের সন্তানরাও ক্ষতিগ্রস্ত৷ এমনকী তাঁদের কেউ কেউ আন্দোলন ভাঙার ডিউটি করতে এসেও একান্ত আলাপে দাবির সমর্থনে কথা বলেছেন৷ পথচারীরাও বলছেন, এই দাবি সরকার মেনে নিক তা আমরাও চাই৷ কিন্তু সরকারি নির্দেশ, প্রতিবাদকে টুঁটি টিপে মারতে হবে৷ তাই লালবাজার থেকে সরকারের বশংবদ উচ্চপদস্থ অফিসারদের নেতৃত্বে বিশেষ বাহিনী পাঠানো হয়েছিল যাতে নৃশংস আক্রমণ করা যায়৷
বেশ কয়েক বছর ধরে পাশ–ফেল চালুর দাবি উঠেছে সারা দেশ জুড়ে৷ শিক্ষাবিদ–শিক্ষক–অভিভাবক-ছাত্র থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মানুষ বারবার দাবি তুলেছেন শিক্ষাকে পঙ্গু করা চলবে না৷পাশ–ফেল তুলে দিয়ে গরিব–মধ্যবিত্ত ঘরের লক্ষ লক্ষ ছাত্রের শিক্ষার মান নষ্ট করতে আমরা দেব না৷ এই দাবিতে হয়েছে অসংখ্য মিছিল, সভা৷ সরকার যখন টালবাহানা করেছে এই দাবি মেনে নিতে, হয়েছে বিক্ষোভ পথ অবরোধ৷
অবশেষে গত বছর ১৭ জুলাই এসইউসিআই(সি) ডাক দিয়েছিল এই দাবিতে বাংলা বনধের৷ রাজ্য সরকার যখন বুঝেছিল এই বনধকে আটকানোর ক্ষমতা কোনও প্রশাসনিক শক্তির নেই, এসইউসিআই(সি) অফিসে চিঠি পাঠিয়ে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, দাবি মেনে নিয়ে সরকার পাশ–ফেল চালু করবে৷ সারা দেশ থেকে একই দাবি উঠছে দেখে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীও বলতে থাকেন, কেন্দ্রীয় সরকারও পাশ–ফেল চালুর কথা ভাবছে৷ কিন্তু তাঁরাও আসলে চেয়েছেন গরিব–মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা, যারা লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে উচ্চশিক্ষা কিনতে পারবে না, তারা কোনও রকমে একটু কাজ চালানো গোছের শিক্ষা নিয়েই শিক্ষাঙ্গন থেকে সরে যাক৷ তাই কেন্দ্রীয় সরকারও ১৮ জুলাই সংসদে শিক্ষার অধিকার আইন সংশোধনের বিল পেশ করার সময় পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল চালুর কথা বলেই আসল বিষয়টি এড়াতে চেয়েছে৷ ১৮ তারিখেই দিল্লিতে হয়েছে বিক্ষোভ মিছিল৷ ১৯ জুলাই সারা দেশে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে৷ তারই অঙ্গ ছিল কলকাতার রাজভবন ঘেরাও৷
আন্দোলন করতে গিয়ে এসইউসিআই(সি) কর্মীরা রক্ত দিয়েছেন বারবার৷ কিন্তু আন্দোলন থেমে থাকেনি৷ তাই দেখা গেল আন্দোলনে একটি চোখ হারিয়েছেন যে যুবক, তিনিও আবার এসে দাঁড়িয়েছেন আন্দোলনের সারিতে৷ রক্তে রোঙানো এই পথেই মুক্তির দিশা খোঁজে মানুষ৷ এই লড়াই জন্ম দেয় উন্নত চরিত্র, মনুষ্যত্বের, এতেই মেরুদণ্ড হয়ে ওঠে ইস্পাত কঠিন৷
তীব্র নিন্দা রাজ্য কমিটির ১৯ জুলাই দলের রাজ্য সম্পাদক কমরেড সৌমেন বসু এক প্রেস বিবৃতিতে পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জের তীব্র নিন্দা করে বলেন, আমরা রাজ্য সরকারকে জানাতে চাই, আগামী দু’মাসের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম শ্রেণি থেকে পাশফেল চালু করার সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা ঘোষণা না করা হলে রাজ্যের সাধারণ মানুষ তাদের সন্তানদের সর্বনাশ রুখতে গোটা বাংলাকে অচল করে দেবে৷ |
(৭০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা ২৭ জুলাই, ২০১৮)