রাজনীতি, সমাজনীতি ও বিজ্ঞানসাধনার ওপর ধর্ম চাপালে তা সমাজপ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করে — শিবদাস ঘোষ

৫ আগস্ট মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ৪৯তম স্মরণদিবস। এই উপলক্ষে তাঁর অমূল্য শিক্ষা থেকে একটি অংশ প্রকাশ করা হল।

‘‘… বহু মানুষ আছেন, যাঁরা মনে করেন, মানবতাবাদী চিন্তা মানুষের মধ্যে আগাগোড়াই ছিল। তাঁদের ধারণা, মানুষের কল্যাণের জন্য যাঁরাই চিন্তা করেছেন– অর্থাৎ বুদ্ধের চিন্তাধারা, যিশুর চিন্তাধারা, মহম্মদের চিন্তাধারা, উপনিষদের ভাবনাধারণাগুলোর মধ্য দিয়ে মানুষের কল্যাণের যা কিছু চিন্তা করা হয়েছে– এঁদের সকলেরই চিন্তাধারায় মানবতাবাদী চিন্তাধারা প্রতিফলিত হয়েছে। এ ভাবে যাঁরা মনে করেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই।

মানুষের কল্যাণের জন্য যেহেতু এঁরা সকলেই চিন্তা করেছেন, সে জন্য সেগুলোকে আমরা মানবিক চিন্তা বলতে পারি। মানুষের কল্যাণের জন্য চিন্তা মানেই মানবতাবাদ নয়। মানবতাবাদ বলতে একটা বিশেষ আদর্শগত, রুচিগত, নীতিগত, এথিক্যাল একটা ক্যাটিগরি, বিচার-বিবেচনার এবং ধ্যান-ধারণার একটা পুরো নতুন মাপকাঠি বোঝায় যাকে একটা বিশেষ পরিমণ্ডল বা সীমা বলতে পারেন। মানবতাবাদের এই বিশেষ ক্যাটিগরির সঙ্গে পূর্বের সমস্ত মানবকল্যাণের ধারণার একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। পূর্বের মানবকল্যাণের ধারণাগুলো বিশেষ যুগের বিশেষ সমাজ জীবনের প্রয়োজন থেকেই গড়ে উঠলেও তা ধর্মীয়, শাশ্বত মূল্যবোধ এবং শাশ্বত সত্যের ধারণা। অর্থাৎ বাস্তবে যে সত্য প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে এবং মরছে, প্রতিদিন যে নতুন নতুন সত্যের জন্ম হচ্ছে, তাকে অস্বীকার করে একটা সত্য যা একটা সময়ে গড়ে উঠল, তাকেই শাশ্বত সত্য রূপে ধরে সবসময়ে সমস্ত অবস্থাতেই সমস্ত বিশেষ সত্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ বলতে এ রকমই শাশ্বত মূল্যবোধের ধারণা বোঝায়।

বাস্তবে, সমাজের প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে, অর্থাৎ চলমান গতির মধ্য থেকে যে প্রয়োজন প্রতিভাত হয়, তাকে কেন্দ্র করেই মূল্যবোধগুলো গড়ে ওঠে। এর আসার ইতিহাস আছে, এর যাওয়ার ইতিহাস আছে। এ বিশেষ সত্য, সর্বসময়ে বিশেষ রূপে প্রতিভাত। এক একটা পরিমণ্ডলের মধ্যে সব বিশেষগুলোকে সমন্বয়ের মাধ্যমে যে একটা সাধারণ সত্যের ধারণা হয়, যা সমস্ত সমাজ জীবনকে, সমস্ত ‘ওয়াকস অফ লাইফ’কে গাইড করে, সেই সাধারণ সত্যের ধারণাও কিন্তু ওই বিশেষ পরিমণ্ডলের সীমার দ্বারা সীমায়িত। আপনাদের মনে রাখা প্রয়োজন, সমাজের মধ্যে প্রচলিত একটা আদর্শবাদ, ন্যায়নীতির একটা কাঠামো– অর্থাৎ ভালমন্দ, উচিত-অনুচিত সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণাগুলো একটা বিশেষ সমাজের বিশেষ অগ্রগতির প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত একটা বিশেষ ধারণা। সেই সময়টা অতিক্রান্ত হলে, সেই প্রয়োজনটা পার করে দিলে সম্পূর্ণ নতুন একটা সমাজব্যবস্থার পরিবেশের সামনে নতুন উৎপাদিকা শক্তি এবং নতুন দ্বন্দ্ব ও সমস্যার ভিত্তিতে যখন নতুন প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন সমাজে নতুন আদর্শবাদেরও প্রয়োজন দেখা দেয়। সেই সময় পুরনো আদর্শবাদ, পুরনো ভালমন্দের যে বিশেষ ধারণা একদিন সমাজ প্রগতিতে সাহায্য করেছে, সমাজকে এগিয়ে দিয়েছে, সমাজের সংহতি ও ঐক্যকে রক্ষা করেছে এবং অন্যায় থেকে মানুষকে বাঁচিয়েছে, তাকেই কেউ ধরে থাকলে সে খোদ নিজেই অন্যায় করতে থাকবে। সে বুঝতে পারবে না, কী করে সে অন্যায় করছে, শুধু র্যাশানালাইজ করবে অবস্থার দোহাই দিয়ে।

আর মনে রাখবেন, এই ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা ক্রমাগত পাল্টাচ্ছে। কিন্তু ন্যায়-অন্যায় সবসময় আছে। তাই নৈতিকতাও সবসময় আছে। এক ধরনের কিছু লোক আছেন যাঁরা মনে করেন, আধুনিক জীবনযাত্রা, বিজ্ঞান ও বস্তুতান্ত্রিক চিন্তা অনুযায়ী ন্যায়নীতি, মূল্যবোধ, নৈতিকতা– এগুলি হচ্ছে সব বুর্জোয়া কুসংস্কার বা সামন্ততান্ত্রিক ধর্মীয় কুসংস্কার। এই সমস্ত লোকেরা বিজ্ঞানের দোহাই দেন, মার্ক্সবাদের কথা বলেন। আমি নিজে মার্ক্সবাদী হয়েও কোনও দিন তাদের সঙ্গে একমত ছিলাম না, আজও নই। আর এক দল ‘প্রায়রি ভ্যালু’ অর্থাৎ পূর্বস্থিরীকৃত সত্ত্বার অস্তিত্ব থেকে উদ্ভূত যে মূল্যবোধগুলোকে দর্শনে প্রায়রি ভ্যালু বলা হয়, সেই মূল্যবোধের মধ্যে ন্যায়নীতি, ভালমন্দ, আদর্শবাদের যে শাশ্বত ও স্থবির কতকগুলো ধারণা আছে, সেইগুলোকেই ‘মর্যালিটি’ মনে করেন। সমস্ত সমাজের যথার্থ ও সত্যিকারের প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে মর্যালিটি বা আদর্শবাদের ধারণা ক্রমাগত পাল্টায়। কিন্তু মব়্যালিটি ও ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা সবসময়ই আছে এবং থাকবে, কেবল তার কনটেন্ট ও ফর্ম পাল্টাবে। তাই, মূল্যবোধের ধারণার একটা বিশেষ ক্যাটিগরি, যেটা এই সীমাকে অতিক্রম করতে গেলেই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করে এবং তার ফলে মানুষের কল্যাণসাধনের সদিচ্ছা সত্ত্বেও আসলে অকল্যাণই সাধন করে বলে নতুন মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তা না হলে শিল্পবিপ্লবকে কেন্দ্র করে সেকুলার মানবতাবাদের জন্ম হত না। এই সেকুলার মানবতাবাদ ইউরোপে গোড়ায় ছিল ধর্মের সাথে আপসহীন, ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে তা আপস করেনি। ধর্মের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল– ওটা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। ‘সেকুলার’ রাষ্ট্রে ধর্মে বিশ্বাসী এবং যে ধর্মে বিশ্বাস করে না উভয়েরই একই অধিকার থাকবে। কিন্তু, রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ন্যায়নীতি, বিজ্ঞানসাধনা এগুলোর ওপর ধর্ম চাপাতে গেলে তা বাধার সৃষ্টি করে। ফলে, এগুলোকে ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। ফলে সেকুলার মানবতাবাদের ভিত্তিতে যে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে তা ধর্মকে বাধা দেবে না, প্রশ্রয়ও দেবে না। ব্যক্তিগতভাবে যদি কেউ ধর্মে বিশ্বাস করে, সে ধর্মীয় আচরণ করতে পারে। কিন্তু, ধর্ম বিশ্বাস করানোর জন্য কাউকে জোর করা চলবে না। প্রথমে মানবতাবাদী আন্দোলনটা ইউরোপে গড়ে উঠেছিল এই ধারণার ভিত্তিতেই। তাদের জাতীয় চরিত্রের মানসিকতা, বলিষ্ঠতা, ব্যক্তিস্বাতন্তে্র্যর গুণাবলিগুলো, নারী স্বাধীনতা সম্বন্ধে ধারণাগুলো, মূল্যবোধের ধারণাগুলো গড়ে উঠেছিল প্রবল সেকুলার আন্দোলনের ভিত্তিতেই। সেকুলার মানবতাবাদের এই ধারণাটা কিন্তু ইউরোপের বুর্জোয়ারা সমাজজীবনে, রাষ্ট্রনীতিতে বেশিদূর পর্যন্ত রক্ষা করতে পারল না। কিছুদূর এগোবার পরই পুঁজিবাদের প্রতিক্রিয়াশীল স্তরে তারা ধীরে ধীরে ‘ক্রিশ্চিয়ানিটি’র মূল সুরের সঙ্গে এই সেকুলার হিউম্যানিজমের একটা আপস করল। যদিও এ কথা তারা আজও বলে না এবং সে জন্য তাদের সংবিধানে এখনও তার প্রতিফলন রয়েছে। তাদের সংবিধানে এখনও রয়েছে যে, ধর্মে বিশ্বাসী এবং যে ধর্মে বিশ্বাস করে না, রাষ্টে্র উভয়েরই সমান অধিকার থাকবে।’’

(শরৎচন্দ্রের চিন্তা ও সাহিত্য রচনা থেকে)